
তাহাদের দুঃখ-শোক

রবীন্দ্রনাথ হলে লিখতেন, ‘প্রাণী জগতে কাকের মতো অভাগা পাখি আর নাই!’ পাখি হয়েও ঠিক পাখির মর্যাদা কখনোই পায়নি কাক। কাকের প্রতি মনুষ্য জাতির বিদ্বেষের ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। তার প্রমাণ মেলে পুরাণে, গল্প-গাথায়।
অথচ মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞান সাক্ষ্য দিচ্ছে, প্রাণিজগতে সবচেয়ে সংবেদনশীল, সবচেয়ে মায়াবী প্রাণীদের অন্যতম হলো কাক। আপনি নিজে হয়তো দেখে থাকবেন, বৈদ্যুতিক খুঁটির তারে বসতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কোনো কাক মারা গেলে নিমিষেই সেখানে হাজির হয়ে যায় শয়ে শয়ে কাক। মৃত কাকটির চারপাশে হাজির হয়ে কাকের দল সম্মিলিত কোরাসে অন্তত মিনিট ১৫ তারস্বরে চিৎকার করে। কাকদের কান্নার সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। তবে বলতে পারেন, প্রিয় স্বজনের মৃত্যুতে এভাবেই আর্তনাদ করে কাকের দল! ‘দেখে মনে হয় এভাবেই তারা প্রকাশ করে মৃত্যুশোক’—কথাটা ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্য প্রাণী বিজ্ঞানী জন মারজলুফের।
প্রাণিজগৎ সম্পর্কে আমাদের মোটের ওপর ধারণাটা একই রকম। পশু-পাখির কাউকে কাউকে আমরা বুদ্ধিমান ভাবি। কেউ কেউ আমাদের কাছে নির্বোধ। কেউবা হিংস্র, কেউ নিরীহ। কিন্তু প্রাণীদের সংবেদনশীল, ‘মানবিক’ আবেগসম্পন্ন হিসেবে দেখতে আমরা অভ্যস্ত নই।
অথচ এমন ভূরি ভূরি নজির আছে, মা শিম্পাঞ্জি অনেক সময়ই তার সদ্যমৃত শিশুটিকে দিনের পর দিন, এমনকি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে। হাতির দল মৃত সঙ্গীটির চারপাশে ঘিরে রাখে অনেক দিন। মৃত সঙ্গীটিকে স্পর্শ করে, নেড়েচেড়ে দেখে। সঙ্গীর মৃত্যু হলে কুকুর বা বিড়াল শোকে নির্জীব হয়ে পড়ে, কয়েক দিন খাবার পর্যন্ত খায় না। বিড়াল অনেক সময় তীব্রতর কান্নায় ভেঙে পড়ে প্রকাশ করে তার শোক।
কাছের কেউ মারা গেলে বেবুনদের স্ট্রেস-হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, এটা পরীক্ষা করেই পাওয়া গেছে। মৃত সঙ্গীর স্মৃতির তাড়নায় বিড়ালদের বারবার সেসব জায়গায় ঘুরতে দেখা যায়, যেখানে তারা তাদের সঙ্গীটির সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। হাতির মতো কাকদের নিজস্ব উপায়ে ‘শেষকৃত্য’ ধরনের আচার পালন করতে দেখা যায়। মৃত কাকের দেহের ওপর তারা ঘাস বা লতাপাতা বিছিয়ে দেয়।
বন্য জীবন ছেড়ে মানুষের সভ্যতায় বহু আগে চলে আসা প্রাণীটির নাম কুকুর। জাপানের একটি কুকুরের গল্প বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছিল, যে তার হারিয়ে যাওয়া প্রভুর সন্ধানে এক দশক ধরে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট রেলস্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করত!
প্রাণীরাও কিন্তু মানুষের মতোই সামাজিক জীব। তারাও পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। আমাদের মতোই তাদের কাছে তাদের সেই সম্পর্কগুলোর গুরুত্ব অনেক। প্রাণীদের শোক বা দুঃখবোধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন বারবারা কিং। কলেজ অব উইলিয়াম অ্যান্ড মেরির নৃতত্ত্বের এই অধ্যাপক বইও লিখেছেন এ নিয়ে—হাউ অ্যানিমেল গ্রিভ। কিং বলছেন, ‘তারা আমাদের মতোই জোড় বেঁধে থাকে। আমরা সবাই আসলে সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ। এমনকি আমাদের মস্তিষ্কও বিচিত্রভাবে অনেক সদৃশ। প্রাণীরাও তাই আমাদের মতো শোক করবে না কেন?’
অধ্যাপক কিং, কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনমূলক জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক মার্ক বেকফসহ আরও কিছু গবেষক বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, মানুষের মতোই শোকের মেঘে আচ্ছন্ন হয় প্রাণিজগতের হূদয়। ব্রিটিশ প্রাণীবিদ ইয়ান ডগলাস-হ্যামিল্টন চমকে গিয়েছিলেন কেনিয়ার জাতীয় উদ্যানে এলিয়ানর নামের এক মা-হাতির মৃত্যুর পর অন্যান্য মা-হাতির প্রতিক্রিয়া দেখে। ২০০৩ সালের ঘটনা এটি। মাত্র ছয় মাস আগে এক শাবকের জন্ম দেওয়ার পর এলিয়ানর অসুস্থ হয়ে মারা যায়। এক সপ্তাহ ধরে ওই গোত্রের অন্যান্য মা-হাতি এসে এলিয়ানের মৃতদেহ পাহারা দিয়ে রাখে। এমনকি যেদিন উদ্যানের কর্মীরা তার মৃতদেহ সরিয়ে নিচ্ছিল গাড়িতে করে, সব হাতি এসে হাজির হয়েছিল সেখানে। ডগলাস-হ্যামিল্টন সে হাতিদের চোখে দেখেছিলেন শোকের প্রতিচ্ছবি।
মানুষ হিসেবে আমরা যখন ক্রমেই যান্ত্রিক হয়ে পড়ছি, মানবিক অনুভূতিগুলো ভোঁতা হতে শুরু করেছে; হয়তো এসব প্রাণীর কাছ থেকেই অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের!
টাইম সাময়িকী অবলম্বনে
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো (১৭/০৫/২০১৩)
রাজীব হাসান