দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ু দূষণের নয়া মাত্রা- "শবদেহ পোড়ানো বাদামী কার্বন"
সাইফুর রহমান সুমন
প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের দরুন দূষিত হয়ে চলেছে আমাদের পরিবেশ আর ভূমণ্ডলকে চারপাশ থেকে ঘিরে রাখা বায়ুমণ্ডল। কলকারখানা, মিল, ফ্যাক্টরি নির্গত কালো ধুঁয়া ছাড়াও আরও নানা রকম নিয়ামক রয়েছে যা বায়ু দূষণে ভূমিকা রাখে চলেছে। পাশাপাশি তা অপেক্ষাকৃত কম হলেও ভূমিকা রেখে চলেছে জলবায়ু পরিবর্তনে।
খুব সম্প্রতি অতিমাত্রায় বায়ু দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে নতুন একটি গবেষণা প্ত্র প্রকাশিত হয়েছে। কাঠ, কয়লা, মাটি প্রভৃতি পুড়ানো থেকে এক ধরনের ক্ষুদ্র কণা যা অ্যারোসল পার্টিকেল নামে পরিচিত উৎপন্ন হয় যা পরবর্তীতে বায়ুর সাথে মিশে বায়ু দূষণ এবং বায়ুমণ্ডল উষ্ণায়নের নিয়ামক হিসেবে বিবেচ্য হয়ে আসছে। এটি অরগানিক বা জৈব কার্বন সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। এটি বায়ুমন্ডলে খুব সহজে মিশে যায় এবং তা সূর্য থেকে আসা আলোক রশ্মি শোষণ করে তাপ ধারণ করে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে চলেছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষত ভারত ও নেপালে এর প্রভাব বেশী। আসুন বিস্তারিত ব্যাখ্যা শোনা যাক ভারতের মরুভুমি গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক রাজন চক্রবর্তী’র গবেষণা থেকে। শবদেহ পোড়ানো থেকে যে অ্যারোসল পার্টিকেল বের হয় তা সূর্যের আলোক রশ্মি অধিক শোষণ করে থাকে। রাজন চক্রবর্তী এ ব্যাপারে বেশ আঞ্চলিক তথ্যানুসন্ধান ও গবেষণা করেন। গবেষণায় তিনি চিহ্নিত করে দেখান যে, মনুষ্য কারণে সৃষ্ট এই ধরনের বায়ু দূষণকারী কার্বন কণা দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রথা অনুযায়ী মৃত দেহকে সৎকারের জন্য কাঠ, কয়লা দিয়ে পুড়ানো হয়। এতে ব্যাবহার করা হয় যথেষ্ট পরিমাণ কাঠ। প্রতি বছর ভারত ও নেপালে শুধুমাত্র এই উদ্দেশে ৭ মিলিয়ন কাঠ পুড়ানো হয় এবং প্রতিটি শব এর ওজন হয়ে থাকে ৫৫০ থেকে ৬০০ কিলোগ্রাম। এই কাঠ পুড়ানো থেকে তৈরী হয় কালো ধুঁয়া, যার ভিতর থাকে জৈব কার্বন কণা। এর ফলে দুই ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে- এক. বায়ু দূষণে ভূমিকা রেখে চলেছে। সৃষ্টি করে চলেছে তৎসম্পর্কিত মানুষ ও প্রাণি দেহের নানাবিধ সমস্যা ও রোগব্যাধী। দুই. এই কালো ধুঁয়ায় থাকে অ্যারোসল পার্টিকেল যা সূর্যের আলোক রশ্মি শোষণ করে তাপ ধারণ করে, যা বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে চলেছে। যদিও এর গ্লোবাল মাত্রা কম তারপরও এটি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এক ধরনের নিয়ামক হিসেবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পর্যবসিত হয়েছে।
জৈব কার্বন সমৃদ্ধ এই অ্যারোসল পার্টিকেল যা সূর্যের আলোক রশ্মি শোষণ করে থাকে তা একটি বিশেষ ‘ব্রাউন কার্বন’ নামে অভিহিত করা হয়। গড় মান হিসেবে এই জৈব অ্যারোসল পার্টিকেলের সূর্যের আলোক রশ্মি শোষণ ক্ষমতা মোট মনুষ্য সৃষ্ট জ্বালানির ২৩ শতাংশ এবং জৈব জ্বালানির ১০ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ায় জৈব জ্বালানি ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে প্রচুর পরিমাণ ব্রাউন কার্বন উৎপন্ন হয়ে থাকে। যেসব কারণে এই অঞ্চলে ব্রাউন কার্বনের বৃহৎ উৎস হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষণাকারীরা –
– ভারত ও নেপালে মৃত দেহ সৎকারের জন্য পোড়ানো হয়ে থাকে, এ থেকে প্রচুর ব্রাউন কার্বন উৎপন্ন হয়।
– এই অঞ্চলে অবস্থিত প্রায় দুই লক্ষ মন্দির, প্যাগোডায় ধুপ, গন্ধক, প্রদীপ, কয়েল, ম্যাক্কো পাউডার, সাদা ও সোনালী ইনসেন্স পাউডার, হোইট ইন্ডিয়ান স্যান্ডাল উড প্রভৃতি দাহ্য বস্তু পুড়ানো হয়। এছাড়া শব দেহ পোড়ানো হয়ে থাকে যা ব্রাউন কার্বনের এক বৃহৎ উৎস হিসেবে চিহ্নিত।
পণ্ডিত রবি শঙ্কর শুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ অধ্যাপক শামস পারভেজের সাথে যৌথ গবেষণায় রাজন চক্রবর্তী দেখিয়েছেন, খোলা স্থানে মৃত দেহ পুড়ানো বা কাঠ-কয়লা পোড়ালে প্রকৃতিতে তার প্রভাব কতটুকু এবং তা কি মাত্রায় বায়ু দূষণ করে থাকে। পাশাপাশি তারা এও দেখিয়েছেন যে তা জলবায়ু পরিবর্তনে কিভাবে ভূমিকা রাখে।
রাজন চক্রবর্তী সহ এই বিষয়টির উপর গবেষণারত বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, আমাদের পরবর্তী কাজ হচ্ছে যত ধরনের ইনসেন্স (ধুপ,গন্ধক,প্রদীপ,আতশবাজি,পটকা প্রভৃতি) পোড়ানো হয় পরিবেশের উপর তার ক্ষতির মাত্রা ও পরিমাণ নির্ধারণ করা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নে এই ধরনের কর্মকাণ্ড যে ভূমিকা রেখে চলেছে তা কিভাবে উপশম করা যায় এবং এর বিকল্প ব্যাবস্থা গবেষণার মাধ্যমে বেড়িয়ে আসুক এটাই আমাদের কাম্য।
তথ্য সুত্র : ফিজিক্স অরগানিজেশন, ইন্ডিয়ান ডেজার্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট।