দুর্লভ এক পরিযায়ী পাখি

দুই দিনের ওয়াইল্ড ট্রিপে রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণি অভয়ারণ্যে গিয়েছিলাম গত ১৫ই মার্চ। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পাখি দেখা। পাশাপাশি এই বনের বিখ্যাত বানর-হনুমান-কাঠবিড়ালীদের দেখার ইচ্ছাতো আছেই। প্রথম দিনেই বেশ ভালো পরিমাণ পাখি আর স্তন্যপায়ীর দেখা পেয়ে আটজনের দলের সবাই বেশ খুশি। ছবিও তোলা হলো প্রচুর। প্রথম দিনটা কালেঙ্গা বিটে ঘোরাঘুরি করেই কেটে গেল। ট্রিপের দ্বিতীয় দিনে আমরা সকাল সকাল রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্ল্যান হচ্ছে কালেঙ্গা থেকে হেঁটে রেমা পর্যন্ত যাওয়া এবং সেদিক দিয়েই প্রস্থান করা। সারাদিন অনেকটা হাঁটতে হবে জেনেও দলের কারোরই উৎসাহের কোন কমতি নেই। নতুন নতুন পাখি দেখা ও তার ছবি তোলার যে আনন্দ ও উত্তেজনা সেটার কাছে সকল পরিশ্রমই তুচ্ছ মনে হয়। Red-headed Trogon (Harpactes erythrocephalus) বা লালমাথা কুচকুচি নামে আমাদের চিরসবুজ বনের এক দুর্লভ আবাসিক প্রজাতির পাখিকে দেখার সম্ভাবনা আছে জানার পর সেই উৎসাহ শতগুণ বেড়ে গেল।549870_10200208926440331_1488344486_n

হাঁটা শুরুর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা ছনবাড়ি বিটে বনবিভাগের যে অফিস আছে সেখানে পৌঁছে গেলাম। আমাদের দেখে বনরক্ষীরা আলাপ করতে এগিয়ে এলেন। এরই মধ্যে আমাদের সামনের একটা ঝাঁকড়া শেওড়া গাছের (Streblus asper) মাথায় হাতের ডানদিক থেকে একটা পাখি উড়ে এসে বসল। প্রথম দেখাতেই পাখিটিকে সাধারণ শালিকদের চেয়ে একটু অন্যরকম লাগছিল। তাই ভালো করে দেখার জন্য চোখে বাইনোকুলার লাগাতেই পাখিটিকে সাথে সাথে চিনতে পারলাম। আমার হৃৎস্পন্দন যেন হঠাৎ করেই বেড়ে গেল। উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠে অন্যদের বলতেই যারা এই পাখির কথা জানেন তারা একরকম হেসেই আমার কথা উড়িয়ে দিলেন। কারণ এই পাখি এখানে দেখার আশা কেউই করেননি। তবে মনে সন্দেহের দোলাচল নিয়েই সবাই দ্রুত তাদের ক্যামেরার শাটার টিপতে থাকলেন। এরই মধ্যে পাখিটি উড়ে যেদিক থেকে এসেছিল আবার সেদিকেই চলে গেছে। উড়ে গিয়ে দূরের একটি গাছে বসার পর আমরা কাছে যেতে যেতে পাখিটি সেখান থেকেও চলে গেল। আর খুঁজে পাওয়া গেল না।

ততক্ষণে আমিনুর রহমান স্যার ছবি চেক করে নিশ্চিত করেছেন যে আমার সনাক্তকরণ একদম নির্ভুল। এই পাখি নিজ চোখে এই প্রথম দেখলেও এর ছবি আগে দেখা ছিল বলে দুর্লভ এই পাখিটি দেখার সাথে সাথেই চিনতে পেরেছি। আলোচ্য পাখিটি হচ্ছে গোলাপি শালিক বা Rosy Starling (Strunus roseus)। অন্য আরেকটি বাংলা নাম হচ্ছে লাল ময়না। এটি বাংলাদেশের অত্যন্ত বিরল একটি পরিযায়ী পাখি। সাম্প্রতিক অতীতে শুধুমাত্র Saint Martin’s Island এ প্রথমে ড. রেজা খান ও পরে অন্যরা এই পাখির দেখা পেয়েছেন ও ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছেন। মূল ভূখণ্ডে অতীতে দুয়েকবার দেখা গেলেও ছবি তোলার ঘটনা এই প্রথম। সেই হিসেবে বিরল এই পাখির দেখা পেয়ে নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করছি। আর আমাদের দলের চারজন এই বিরল মুহূর্তকে তাদের ক্যামেরায় বন্দী করতে সক্ষম হয়েছেন। সৌভাগ্যই বটে!

পূর্ণবয়স্ক গোলাপি শালিককে এদের গায়ের রঙের কারণে অন্য শালিকদের থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। আকারে আমাদের চেনা গো-শালিক (Asian Pied Starling, Sturnus contra) এর সমান হলেও গোলাপি শালিকের মাথায় ঝুঁটি ও গায়ে বাহারি রং লক্ষ্য করা যায়। এদের গায়ের রং গোলাপি, পা ও ঠোঁট ফ্যাকাশে কমলা আর মাথা, ডানা ও লেজ চকচকে কালো। প্রজনন ঋতুতে পুরুষের মাথার ঝুঁটিটি অন্য সময়ের চেয়ে আকারে বড় হয়। মেয়ে পাখির ঝুঁটি আকারে ছোট ও গায়ের রং পুরুষের তুলনায় অনুজ্জ্বল। শীতকালীন পালক প্রজনন মৌসুমের তুলনায় বিবর্ণ দেখায়। এদের পছন্দ আবাদী জমি, ঘাসবন, কাঁটাঝোপ ও ফলযুক্ত তরুবীথি। এরা মূলত ফল, ফলের রস, দানাশস্য ও পোকা-মাকড় খায় তবে শেষোক্তটিই বেশি পছন্দ করে। কখনো ছোট দল আবার কখনো বড় ঝাঁকে ঘুরতে দেখা যায়। মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের শুষ্ক ও তৃণাবৃত প্রান্তরে মে-জুন সময়কালে এরা বংশবৃদ্ধি করে। বিরাট কলোনি  একসাথে বাসা বানায় পাহাড়ের পাথরের খাঁজের গর্ত বা ফাটলে। খনি বা পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপেও বাসা করতে দেখা যায়। মেয়ে শালিক ৩-৫টি ফ্যাকাশে নীল ডিম পাড়ে।

আশা করি আমাদের দেশে এই পাখিটি যেন ভালোভাবে বেঁচে থাকে। এই বিরল পাখিটির এই দেশে অবস্থান সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। তাই এ ব্যাপারে আরো ব্যাপক গবেষণায় প্রাণিবিজ্ঞানীরা এগিয়ে আসবেন আশা করি।

আলী রেজা হায়দার

পেশায় সহকারী কমিশনার (শুল্ক, আবগারি ও ভ্যাট), পাখিপ্রেমী

(সংযুক্ত ছবির স্বত্বাধিকারী: Sahad Siddique)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics