নিপাহ ভাইরাসঃ সতর্কতাই উত্তম পন্থা

রাহুল দাশ তালুকদার

বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর নানা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে স্তন্যপায়ী দ্বারা পোষিত ভাইরাসের সংখ্যাও কম নয়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে যে ভাইরাসটি জনমনে ব্যাপক আতংক সৃষ্টি করেছে সেটি নিপাহ ভাইরাস। নাম খুব সাদামাটা হলেও এ ভাইরাসটি কিন্তু খুবই মারাত্মক।
প্যারামিক্সোভিরিডি (Paramyxoviridae) গোত্রের  অন্তর্গত ২টি সদস্যের একটি হচ্ছে নিপাহ ভাইরাস। টেরোপাস গোত্রের ফলাহারী বাদুর (fruit bat) এই ভাইরাসগুলোর প্রাকৃতিক পোষক। ভাইরাসগুলোর বৈশিষ্ট্যমূলক বৃহৎ জিনোম এবং বিস্তৃত পোষকশ্রেনী রয়েছে। নিপাহ ভাইরাস একটি Emerging zoonotic ভাইরাস অর্থাৎ প্রানি থেকে মানুষে ছড়ানো ভাইরাস। ভাইরাসটি মস্তিষ্ক এবং শ্বসনতন্ত্রে প্রদাহ তৈরীর মাধ্যমে মারাত্মক অসুস্থতার সৃষ্টি করে। মালয়েশিয়ার আচেহ প্রদেশের নিপাহ গ্রামে এই ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে বলে একে পরবর্তী সময়ে নিপাহ ভাইরাস নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৯৮-৯৯ সালে মালয়েশিয়ার ‘নিপাহ’ গ্রামে এবং বাংলাদেশে ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় প্রথমে ‘অজ্ঞাত’ রোগ হিসেবে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখ দেয়। পরবর্তী সময়ে এটি নিপাহ ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত হয়।  হঠাৎ করে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট লোকালয়ে কোনো রোগ বেশি পরিমাণে দেখা দিলে তাকে ‘রোগের প্রাদুর্ভাব’ বা ডিজিজ আউটব্রেক হিসেবে অভিহিত করা হয়। মহাখালীর জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত মোট নয়টি ‘আউটব্রেক’ বা নিপাহ ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব শনাক্ত করেছে। শূকর ও বাদুড় এই ভাইরাসের বাহক।nipah virus map বাংলাদেশে বাদুড় থেকে এটি ছড়িয়েছে। মূলত শূকরের সংস্পর্শে আসা মানুষজন এতে আক্রান্ত হলেও বাদুড় এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক পোষক বা হোস্ট। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ। বাংলাদেশে মূলত বাদুড় থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়। বাদুড়ের লালা, কিংবা মল-মূত্রের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। বাংলাদেশে কাঁচা খেজুরের রস খুব জনপ্রিয় পানীয়। খেজুড় গাছের রস যদি বাদুড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয় তবে ওই রস থেকে কিংবা বাদুড়ে খেয়েছে এমন ফল থেকে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। আক্রান্ত শূকরের সংস্পর্শ, তাদের লালা ও সংক্রমিত মাংশের মাধ্যমে এর বিস্তার ঘটে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা যায় যে, জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশে নিপাহে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে বেশি। তাছাড়া এ ভাইরাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নষ্ট হয়। তাই সংগৃহীত রস জ্বাল দিয়ে পান করা হলে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে না।

ভাইরাসগুলো শরীরে ঢোকার ৪ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে রোগের লক্ষণসমূহ প্রকাশ পায়। ইনফ্লুয়েঞ্জার মত জ্বর, মাথা ব্যথা, পেশিতে ব্যথা, বমি, ইত্যাদি থেকে শুরু করে মাথা ঘোরা, শ্বাস কষ্ট, নিউমোনিয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া- এসব লক্ষণ দেখা দেয়। বেঁচে যাওয়া রোগীদের প্রায় ১৫-২০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্নায়ুবিক দুর্বলতা থেকে যায়।nipah-virus

নিপা ভাইরাস জনিত এনকেফালাইটিসের খুব কার্যকর কোন চিকিৎসা আসলে নেই। প্রাথমিক পর্যায়ে রিভাবিরিন জাতীয় এন্টিভাইরাল ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে রোগের তীব্রতা কিছুটা কমে। কাশি, জ্বর বা অন্যান্য লক্ষণের জন্য লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হয়। এন্টিবায়োটিকের সরাসরি  কোন ভূমিকা না  থাকলেও সেকেন্ডারী ইনফেকশন প্রতিরোধে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যেতে পারে। তীব্র শ্বাস কষ্ট দেখা দিলে বা রোগী অচেতন হয়ে গেলে প্রয়োজনে ভেন্টিলেটর মেশিন (কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র)-এর মাধ্যমে কৃত্রিম ভাবে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যাবস্থা করতে হতে পারে।
এলাইজা টেস্ট, পিসিআর, সেল কালচার প্রভৃতি পরীক্ষার মাধ্যমে এই ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব।
নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধের জন্য কোন টিকা নাই। যেহেতু সংক্রমিত খেজুরের রস ও বাদুরে খাওয়া ফলমূলের মাধ্যমে ভাইরাসগুলো মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে, তাই কাঁচা খেজুরের রস ও বাদুরে খাওয়া ফলমূল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। খেজুরের রস ভাল করে ফুটিয়ে নিলে নিপাহ ভাইরাস মরে যায়। তাই খেজুরের রস ভাল করে ফুটিয়ে খেতে হবে। আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে সাবধান থাকতে হবে। ভাল করে ঘন ঘন হাত ধুয়ে নিতে হবে।

তবে আশার বিষয় এই যে বৈজ্ঞানিকগণ  নিপা ভাইরাসের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকরী এক ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন বলে এক রিপোর্টে জানা গেছে।  তারা বলেছেন, “হেন্দ্রা ভাইরাস এর G glycoprotein সাবইউনিট ভ্যাকসিন আফ্রিকান সবুজ বানরদের নিপা ভাইরাসের চ্যালেঞ্জকে প্রতিরোধ করেছে।” অদূর ভবিষ্যতে মানুষের শরীরে এই ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রকাশ পাবে বলে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী।

লেখকঃ সভাপতি, প্রাধিকার – সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics