'পরিবেশবন্ধু' জাকির এখন জেলে!
নাম জাকির হোসেন, সাতক্ষীরার বাসিন্দা। জাকির হোসেন নামের চেয়ে যিনি তার এলাকায় ‘পরিবেশ বন্ধু’ নামেই অধিক পরিচিত। আর তা হবেই বা না কেন? ২০০৯ সালের ২৫ মে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস আইলার পরে বনায়ন করে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ রক্ষায় অনন্য ভূমিকা রেখেছেন এবং রেখে চলেছিলেন পরিবেশের প্রতি নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটি। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন সামাজিক বনায়নে। লবণ-সহনশীল তাল, খেজুর, তেঁতুল, পরশপেপুল, কদবেল, নিম, বাবলা এবং বাঁধ সংলগ্ন নদীর চরে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির কেওড়া, গোলপাতা, বাইন, কাঁকড়া, খলিশা, গরান, পশুর ও হরকোচা গাছের নার্সারি তৈরি করে বিনামূল্যে হাজার হাজার চারা বিতরণ করেছেন নিজ এলাকার মানুষের মধ্যে। উদ্দেশ্য ছিল বেড়িবাঁধ রক্ষা করে এলাকার মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচানো। এহেন কর্মকাণ্ডের পুরষ্কার স্বরূপ পেয়েছেন স্থানীয়ভাবে জলবায়ু সম্মাননা।
আমাদের যে পরিবেশ আজ বিপন্নের পথে, নানাবিধ মনুষ্য কর্মকাণ্ডের দরুন আজকে যেখানে ডুবতে বসেছে আমাদের মানচিত্র, সেখানে আমরা কতটুকুই পরিবেশ রক্ষায় ভুমিকা রাখতে পারেছি? পরিবেশ রক্ষায় যেখানে আমাদের প্রয়োজন এরকম আরো হাজারো জাকির হোসেন, সেখানে এই পরিবেশ বন্ধুকেই এখন থাকতে হচ্ছে কারাগারের ভিতরে। গুনতে হচ্ছে ভালো কাজের মাশুল। ‘পরিবেশবন্ধু’ জাকির এখন নদীর বেড়িবাঁধ কাটার মামলায় জেলে।
জাকির হোসেন সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুরের পাখিমারা গ্রামের আবুল হোসেন মোড়লের ছেলে। পেশায় ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক জাকির হোসেন এলাকায় ‘পরিবেশবন্ধু’ বলেই পরিচিত। সম্প্রতি জানা যায়, আইলার পরে দ্বীপ ইউনিয়ন পদ্মপুকুরে দীর্ঘ দুই বছর ধরে লবণপানির জোয়ার-ভাটা চলছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল বাঁধ সুরক্ষিত করা। কেউ এগিয়ে আসেনি। এগিয়ে এসেছিলেন জাকির। নিজ উদ্যোগেই খোলপেটুয়া নদীর প্রায় ২ কিলোমিটার চর বনায়ন করে বাঁধ রক্ষা করেছেন। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে লবণ-সহনশীল গাছের নার্সারি তৈরি করে বিনামূল্যে হাজার হাজার চারা বিতরণ করেছেন। কিন্তু তাকেই জেলে ঢোকানো হয়েছে বাঁধ কাটার মামলায়।
স্থানীয়রা আরও জানান, ‘পরিবেশবন্ধু’ জাকিরের কোনো দোষ ছিল না। তিনি ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালান। সেদিনের বাঁধ কাটার ঘটনা তিনি জানতেনও না। রাতের আঁধারে দুর্বৃত্তরা বাঁধ কেটেছে, আর জাকিরকে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। তাকে বানানো হয়েছে হুকুমের আসামি। স্থানীয় পরিবেশ গবেষক শাহীন ইসলাম মারফত যানা যায়, দীর্ঘ ৫ বছর ধরে জাকিরকে এলাকার পরিবেশরক্ষায় সংগ্রাম করতে দেখেছি। সে সারাদিন ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালালেও সময় বের করে নিজের লাগানো গাছগুলো পরিচর্চা করত। মানুষকে গাছ লাগাতে উৎসাহিত করেছে, তাকে অহেতুক মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ সামাজিক কাজ করতে উৎসাহ হারাবে। সাতক্ষীরা জেলা কারাগার থেকে সরাসরি জাকির হোসেন জানান,
‘আইলার পরে দু’বছর ধরে জোয়ার-ভাটার পানি উঠানামা করতো। পানি নেমে যাওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু লবণাক্ততার কারণে গাছগুলো বাঁচেনি। প্রতি বছর অনেক টাকার গাছ কিনে লাগাতাম। পরে পার্শ্ববর্তী খুলনা জেলার কয়রায় নদীর চর বনায়নের কাজ দেখে খুবই ভাল লেগেছিল। সেখান থেকেই খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ ও জেগে ওঠা চরে গাছ লাগানো শুরু করি। হাজার হাজার মানুষকে বিনামূল্যে চারা দিয়েছি। এর স্বীকৃতি হিসেবে আমাকে জলবায়ু সম্মাননাও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সম্মাননা কি এখন আমার বউ-বাচ্চাকে খাওয়াবে?’— প্রশ্ন করেন জাকির।
উল্লেখ্য, খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ কেটে দেওয়ার অভিযোগে ১৫ মার্চ শ্যামনগর থানায় ৩২ জনকে আসামি করে একটি মামলা (১৫/৭৮) রেকর্ড করা হয়। ওই মামলায় জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে হুকুম দেওয়ার অভিযোগ এনে তাকে ৭ নম্বর আসামি করা হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল বেড়িবাঁধ কেটে ফসলি জমিতে জোয়ারের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায়। এতে ফসলি জমির যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি গাছপালারও ব্যাপক ক্ষতি হয়। জাকির হোসেন এ বিষয়টির প্রতিবাদ করায় তাকে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা কিছু প্রভাবশালীর রোষানলে পড়তে হয়েছে, যেতে হয়েছে জেলে।
পরিবেশভিত্তিক সংগঠন ‘সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি’ টিমের সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন পরিবেশ বন্ধু জাকির হোসেন সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, যুব জলবায়ু ক্যাম্প-২০১৩ এ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে স্বেচ্ছাশ্রমে আজীবন নিজের ইউনিয়নের চারিধারে সবুজ বেষ্টনি গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন জাকির হোসেন। শ্যামনগর উপজেলায় বনায়নে বিশেষ অবদান রাখায় জলবায়ু সম্মাননাও পেয়েছেন তিনি। কিন্তু কেন তাকে আজ জেলে যেতে হলো কেউ জানে না।
তিনি অবিলম্বে জাকির হোসেনের মুক্তির দাবি জানান।
সুত্রঃ বাংলানিউজ২৪.কম