পাতি সবুজ তাউরা

150438_10152725189030471_1445580066_n

জঙ্গলের নাম বারৈয়ারঢালা। নামটা যথেষ্টই নতুন আমার কাছে- জায়গাটাও। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিসে গিয়ে সাত সকালে তাদের দেখা পাওয়ার আশা করাটা বোকামি। তবুও নতুন জঙ্গল- তাই হানা দিলাম অফিস-ঘেষা কোয়ার্টারে। ঘড়ির কাটায় তখনও সাতটা বাজেনি। সুয্যি মামা উঠব উঠব করেও আলস্যের কাছে পরাজিত- কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। এমন সময় রেঞ্জ অফিসারের স্ত্রীর হাক কানে এল। অচেনা মানুষ সাত সকালে বাড়ির আঙিনায় ঘুর ঘুর করলে এটা তো পাওনা হবেই। তবে খানিক বাদেই বুঝলাম তিনি হাকটা ছেড়েছেন আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই, আর উদ্দেশ্য অতি মহৎ- সকালের নাস্তার ভাগ অতিথিকে দিতে চান। নাস্তাটাও সেইরকম- খেজুরের রস দিয়ে তৈরি দুধ চিতই পিঠা আর ভাপা পিঠা। আহা- আর কী লাগে। (আমি বরাবর পেটুক এই বেলায় এটা বলে রাখি) বারান্দায় বসে খেতে খেতে দেখছি শালিক- বুলবুলির ঝাক। মাঝে মাঝে টিয়ার কর্কশ গলার চিৎকার আর কাঠঠোকরার সাইরেন। পাশের পুকুরে ছোট মাছরাঙা শীত উপেক্ষা করেই মাছের জন্য ডুব মারছে। আর তার সাথেই রেঞ্জ অফিসার আর বিট অফিসারের বকবক- ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণা করলেই হল- কোন অবকাঠামো উন্নয়ন নেই- কেউ বেড়াতে এলে পিকনিক করার জায়গা নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। বেচারাদের মাথায় ন্যাশনাল পার্ক মানেই পিকনিক করার জায়গা!! এদের এই ধারণা বদলানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। তাদের সাথে কথা বলা শেষ করে ঢুকলাম জঙ্গলে।
পাহাড়ি ঝিরিতে শীতের সময়ে একদম পানি থাকে না- খটখটে শুকনো। স্রোতের অপেক্ষায় তাই কোথাও কোথাও দলছুট কিছু পানি আটকে আছে। সূর্যের আলো এই শীতে মাটিকে আদরের প্রলেপ মাখাতে চাইলেও বেয়াড়া গাছের পাতাগুলোর জন্য পারছে না। তাই আলোর রশ্মিগুলো পাতার আড়াল থেকেই যেখানে ফাঁক পাচ্ছে সেখান থেকেই গলে বেরনোর চেষ্টা করছে। জমে থাকা পানির কাছে দেখা পেলাম গ্রে ওয়াগটেলের, খানিকদূরে ব্ল্যাক-ব্যাকড ফর্কটেইলের। হঠাৎ করেই সন্ধান পেলাম একটি মিক্সড স্পিশিজ হান্টিং পার্টির অর্থাৎ অনেক প্রজাতির পাখি একসাথে মিলে মিশে শিকার ধরে। বড় মালা পেঙ্গা পাখির ঝাঁকের সাথে ফিঙে আর ভীমরাজ। তাদের ঝগড়াতে কান পাতা দায়। কোনভাবেই এদের এই ঐকতানকে ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতের ধারে কাছেও ফেলা যাবে না, যদি এই মিশ্র কলতানকে কোন কিছুর সাথে তুলনা দিতেই হয়- তবে সেটা হেভি মেটাল ব্যান্ডের! এর মধ্যেই হঠাৎ করে কাঠঠোকরার মত লাফিয়ে আর ভোকাল চড়িয়ে বেশ জোরে ডেকে  যাচ্ছিল- এমন একটি পাখির দিকে দৃষ্টি আটকে গেল। পাখির ডাকের মধ্যেই মিশে ছিল করুণ বিলাপের মত:……. আয়েইউ………… ডাক। রঙের কারবারি এই পাখিটির দিকে তাকিয়েই রইলাম মুগ্ধ বিস্ময়ে।
রক্ত লাল চোখ, আর প্রবাল লাল পা- তামাটে মেরুন রঙের ডানাসহ পিঠ পাতার সাথে মিশে যাওয়া সবুজ। শরীরের নিচের দিকে সবুজ রং হালকা হয়ে এসেছে। ছোট্ট একটা সবুজ ঝুটি মাথার পিছনে। মোটা কালো ডোরা ঘাড়ের পিছন পর্যন্ত গিয়ে ঝুটিকে দেখার মত করে তুলেছে। ডানার গোড়ার পালক আর লম্বা লেজের পালকের আগা সাদা। পাখির নাম পাতি সবুজতাউরা।
জীবনে প্রথমবারের মত এই পাখিকে দেখে রীতিমত বিস্মিত! বাকরূদ্ধ!! পুরো দলে এই একটি গ্রিন ম্যাগপাই- রাজার মতই। এই পাখিটির ছবি দেখেছি, তবে সামনাসামনি আমার মতন নিতান্ত নবিশ পাখিপ্রেমীকে তিনি দেখা দেবেন তা ভাবিনি। এই পাখির বৈজ্ঞানিক নাম cissa chinensis – অর্থাৎ চিনের ল্যাঞ্জা দোয়েল।
পাতি সবুজতাউরা ঘন চিরসবুজ বনে বা আর্দ্র পাতাঝরা বনে ঘুরে বেড়ায়- কখনো একা, কখনো জোড়ায়। আবার কখনো এই রকম মিশ্র ঝাকে। ব্যাং, টিকটিকি, সাপ, পাখি, পাখির ডিম, বড় পোকা, পচা মাংস কিছুতেই অরুচি নেই। এই পাখিটি বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। চট্টগ্রাম, সিলেটের বনে দেখা মেলে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় এই পাখি রয়েছে। বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত এই পাখি বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে সংরক্ষিত এবং অপ্রতুল তথ্য শ্রেণিতে রয়েছে।

লেখকঃ আল মারুফ রাসেল

গবেষণা সহকারী, ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশ, প্রতিবেদক- ডেইলি সান।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics