পাথরের বন

stone-forest-madagascar2আস্তে আস্তে এগোচ্ছে গিরগিটিটা। প্রচণ্ড রোদে তেতে উঠেছে পাথরের গা। গবেষক নেইল শিয়ায়
হালকা ছায়া পড়ছে এখানে-সেখানে। পাথরের বন নিয়ে গবেষণায় তার এ ছুটে চলা। ছায়ায় শরীর মিশিয়ে এগোচ্ছে। খুব সতর্ক ভঙ্গি। এদিক-সেদিক তাকিয়ে এগোল কয়েক পা। হঠাৎ করেই জমে গেল। নড়চড় নেই একটুও। আঁচ করে ফেলেছে শিকারির শ্যেনদৃষ্টি। তড়িঘড়ি লুকিয়ে পড়ল গোলাপ ঝাড়ের আড়ালে। খাঁজকাটা কাঁটাগুলো তার দুর্গ! সময় যেন থেমে আছে। হঠাৎ সব নিস্তব্ধতা ভেঙে চেঁচিয়ে উড়ে গেল বেরসিক তোতা। ঠিক তখনই হামলে পড়ল শত্র“। চেপেধরল খপ করে। উল্টেপাল্টে দেখল খানিকক্ষণ। কৌতূহল মিটিয়ে আলগা করল মুঠো ‘মনে হচ্ছে নতুন প্রজাতি!’
সিনজি ন্যাশনাল পার্কে (স্থানীয়রা মালাগাসি ভাষায় এ বনকে ডাকে সেনজে দে বেমারাহা, মানে চুনা পাথরের বন)। বিশ্বের মানুষ চেনে ‘স্টোন ফরেস্ট’ নামে। জীববৈচিত্র্যের এ স্বর্গভূমিতে হাজির হয়েই যেন পাগল হয়ে গেছে তরুণ সরীসৃপ গবেষক। মাঝে-মধ্যেই হামলে পড়ছে অচেনা প্রাণীর ওপর। ওর চকচকে চোখ দেখেই বুঝতে পারছি দেখা হয়েছে নতুন প্রজাতির সঙ্গে। হ্যারি রাকোতন্দ্রাবেনির আর দোষ কি! ৭৫২ বর্গ মাইলের সংরক্ষিত এই বনের ৯০ শতাংশেরও বেশি প্রজাতির প্রাণীই তো দেখা যায় না অন্য কোথাও!
বনটি চুনাপাথরের। আকাশছোঁয়া পাথরের ভাঁজে ভাঁজে সবুজের সমারোহ। ভূতাত্ত্বিকভাবে দুটি ভাগ সিনজির গ্রেট সিনজি আর লিটল সিনজি। বিভক্তি ছোট-বড় নয়, করা হয়েছে চূড়াগুলোর উচ্চতার ভিত্তিতে। ভাগ দুটি মিলেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাথরের বন। অন্ধকারে ছিল বহুকাল। ১৯৯০ সালে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের স্বীকৃতি পেয়েছে। তারপর থেকেই দলে দলে আসছেন গবেষকরা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নয়া প্রজাতির প্রাণী আবিষ্কারের তালিকাও। ১০০ প্রজাতির পাখি, ৪৫ ধরনের সরীসৃপ, ১১ প্রজাতির লেমুরের বসতি সিনজি। আরো আছে বুনো হাঁস, সারস। ১৯৯০ সালে পাওয়া গিয়েছিল লম্বা পায়ের লেমুর। আছে নানা জাতের সারস, ঈগল, বুনো হাঁস, ছোট বাজপাখি, ইঁদুর আর শিকারি কুকুর। ২০০০ সালে খুদে লেমুর, ২০০৫-এ বাঁদর, ২০০৭ সালে আবিষ্কার করা হয় ব্যাঙের নতুন প্রজাতি। আমাদের পেয়ে শিশুর মতো উচ্ছল হয়ে গেলেন স্টিভেন গুডম্যান। ২০ বছর বসবাস করছেন মাদাগাস্কারে। সিনজির কথা উঠতেই জীববিজ্ঞানীর বলিরেখাভর্তি মুখে খেলে গেল আনন্দ ‘এটা হলো স্বর্গের ভেতরে প্রাণীদের একটু করো স্বর্গ।’ স্টোন ফরেস্টের প্রাণিবৈচিত্র্যে মুগ্ধ প্রবীণ এ বিজ্ঞানীর কথা যেন থামতেই চাইছে না ‘এক-দুই পা হাঁটতেই দেখবে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা কোনো প্রাণী! বিশ্বাস করো, এমনটি দেখিনি আর কোথাও।’ ‘উপত্যকার মাঝ বরাবর হেঁটে যাও, দেখবে অনেক কিছুই,’ যাওয়ার আগে উপদেশ দিলেন।
স্টোন ফরেস্টে পৌঁছানো খুব কষ্টের সময়টা বর্ষার গোড়ার দিকে। এ সময় পাতা শুকিয়ে ঝরে পড়ে, প্রচণ্ড শীত নামে। মাদাগাস্কারের রাজধানী আনতানানারিভো থেকে সিনজি পৌঁছতেই লেগে গেল পুরো পাঁচ দিন! যাওয়ার পথে ক্রমেই অদৃশ্য হতে লাগল আধুনিক বিশ্ব। পিচঢালা রাস্তা বাঁক নিল এবড়ো থেবড়ো মাটিতে। কমতে কমতে উধাও হয়ে গেল গাড়িসহ অন্যান্য বাহন। ছোট হতে হতে একসময় হারিয়েই গেল ছড়ানো-ছিটানো গ্রাম। হ্যারি নিজেই গাইড। এ নিয়ে সিনজি এল চারবার। তার পরও মুগ্ধতা কমেনি। খানিক পর পরই গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামছে, ঢুকে পড়ছে ঝোপঝাড়ে। কখনো আস্ত সাপ গলায় ঝুলিয়ে দেখায়, কখনো হাতের মুঠোয় বেজারমুখো গিরগিটি। মানুষের আচরণে ওরা যেন খুব বিরক্ত!
সূত্রঃ দৈনিক মানব কণ্ঠ ১৭/০৬/২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics