পিসিবি আবিস্কার কি বিজ্ঞানের উপহাস ???
মিথিলা চক্রবর্তী
সৃষ্টির শুরু থেকে এই একবিংশ শতাব্দীর ঠিক এই মুহূর্তটি পর্যন্ত বিজ্ঞানের বিকাশ- বিস্তৃতি মানব জীবন নয় শুধু, পুরো সৃষ্টি জগতেই ঘটিয়েছে আমূল পরিবর্তন। খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে ২০১৩ সাল,বিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা হয়ে রয়েছে রসায়ন। আর হাইড্রোকার্বনস এর আবিস্কার, শিল্পের বিকাশে যে গতি দিয়েছে তার ফলাফল খুঁজতে কোন আতশি কাঁচেরও প্রয়োজন পরেনা। তবে, আবিস্কার যে সবসময় বা সবক্ষেত্রে আমাদের বা পরিবেশ-প্রাণী জগতের উপকারে এসেছে তা নয়, মাঝে মাঝে এমন কিছু আবিস্কার বিজ্ঞান আমাদের উপহার দেয় যার যোগফল দাঁড়ায় শুধুই উপহাস!!!
চলুন দেখে নেয়া যাক, একটা বৈজ্ঞানিক উপহাসের উদাহরণ। পিসিবি’স বা পলিক্লোরিনেটেড বাইফিনাইল PCBs(Poly Chlorinated Biphenyl) ক্লোরিন সমৃদ্ধ এক ধরনের হাইড্রোকার্বন। যা মনুষ্যসৃষ্ট জৈব রাসায়নিক পদার্থের বিস্তৃত পরিবারের অন্তর্গত । বাইফিনাইল অণুর সরাসরি ক্লোরিনেশনের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয় পিসিবি’স। বাইফিনাইল অণু দুটি বেনজিন অণুর সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে উৎপাদিত হয়, যেখানে, ১-১০ অবস্থানের হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো ক্লোরিনেশন পর্যায়ে ক্লোরিন পরমাণু দ্বারা পরিবর্তিত হয়। আমাদের উপহাসের নায়ক বটে আজ সে !!!
পিসিবি’স এর প্রথম বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ১৯২৯ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনসান্টো কেমিক্যাল কোম্পানি প্রথম এটি বাজারজাত করে, যার সাধারণ ট্রেড নাম এরোক্লোর(aroclor)।এর কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে এটির বহুল বাণিজ্যিক বা শিল্প ভিত্তিক ব্যবহার দেখা গেছে। যেমন, পিসিবি’স গুলো পানিতে দ্রবীভূত হয় না, শুকিয়ে যায় না বা খুব কম সময়েই এদের শুকনো হতে দেখা গেছে,এগুলো দাহ্য নয়,গলনাঙ্ক উচ্চ,চাপ সহ্য করার রয়েছে অদ্ভুত ক্ষমতা, রয়েছে উচ্চ রাসায়নিক স্থায়িত্ব, এমনকি এগুলো বিদ্যুৎ অপরিবাহীও বটে।
এবার দেখে নেয়া যাক এদের ব্যবহার; কঠিন বস্তু পাতলা করতে , হালকা রঙের তরল থেকে তারতম্য দূর করতে, বৈদ্যুতিক অন্তরক তৈরিতে,রঙ বা বার্নিশ তৈরিতে,কার্বন পেপার তৈরিতে,ছাপার কালি প্রস্তুত করতে,প্লাসটিক শিল্পে, কৃত্তিম আঠা তৈরিতে, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারে, লুব্রিকেটিং তেল, এবং জলবাহী সরঞ্জাম সহ বহু শিল্পে এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
এই অতি উপকারি রাসায়নিক, মানব আবং অনান্য প্রাণী জগতের জন্য এক অভিশাপ বটে।১৯৬৮ সালে জাপানে ও পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে তাইওয়ানে ”Yu-sho” ও “Yu-cheng” এই দুই ঘটনাই পিসিবি’স কে বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের আগেই লাইমলাইটে নিয়ে আসে । সেচের মাধ্যমে নদীর পানিতে মিশে থাকা পিসিবি ধানের মধ্যে সঞ্চিত হয়, সেই ধানের তৈরি চাল থেকে যে খাদ্য উৎপাদিত হয়েছিল তা থেকেই মূলত এক ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা হয়। ০.৫ পিপিএম মাত্রা যেখানে সহনীয় সেখানে ২০০০ থেকে ৩০০০ পিপিএম ঘনত্বের পিসিবি উঠে আসে ধানের সাথে। ফলাফল; ১৭০০ টি প্রাণ অকালে ঝড়ে পরে। হাজার মানুষের জীবনাবসানের সাক্ষী হয় ইতিহাস। গাছ থেকে শুরু করে মৎস্য সম্পদ বা জলীয় বাস্তুতন্ত্রের একটি বিরাট অংশ পিসিবি দূষণের শিকার হয়ে থাকে। গাছ ,পানি ও পুষ্টিগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে পিসিবিও গ্রহণ করে থাকে, যার ফলে, গাছের বিভিন্ন শরীর বৃত্তীয় কাজে অসুবিধা দেখা দেয় এবং অবশেষে গাছটি মারাও যেতে পারে। মাছ কিংবা অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষেত্রে পিসিবি গ্রহণের ফলে শ্বাস প্রশ্বাসে এবং শরীর বৃত্তীয় কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং অতিমাত্রায় দূষণ এদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।আর দূষিত গাছ থেকে উৎপাদিত ফল বা শস্য গ্রহণ করলে বা দূষিত মাছ খেয়ে বিপদে পরে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীকুল। পিসিবি’র বহুল ব্যবহার এর অবাধে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পরাকে তরান্বিত করছে। জল থেকে স্থল আর স্থল থেকে জল, প্রকৃতি তার সব উপাদান সহ জিম্মি এইসব নিরব ঘাতকদের কাছে। ক্যান্সার, মানসিক বিকলাঙ্গতা চর্ম রোগ, ক্ষুধা মন্দা, মাথা ব্যাথা, কিডনি, লিভার, পাকস্থলীর নানা জটিল রোগ হতে পারে পিসিবি আক্রান্ত হলে। এর প্রতিদান মানব সভ্যতাকে এগিয়ে দিচ্ছে বটে তবে, রেখে যাচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত। বাংলাদেশের মত অনেক উন্নয়নশীল দেশেই নিরাপত্তার চাদরে চলছে পিসিবি’র এর বিস্তার।সরকারি- বেসরকারি সহ ব্যাক্তি সচেতনতা, মানসিকতার পরিবর্তনই পারে আনতে মুক্তি, দিতে পারে আপাত স্বস্তি।