
প্রজাপতিঃ রঙিন ডানায় হাজার রহস্য
শাওন চৌধুরী
‘প্রজাপতি’ শব্দটা শুনলেই প্রথমেই আমাদের মাথায় রঙবেরঙের পাখাওয়ালা পতংগের ছবি ভেসে ওঠে যারা কিনা মধু আহরণের জন্য ক্ষণিকের জন্য কোন ফুলের ওপরে বসে পরক্ষণেই উড়ে যায় এবং ফুলে ফুলে উড়েই এদের সময় কেটে যায়। হয়তো শহরের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী থাকার কারণে আমাদের অনেকেরই নানান রঙের প্রজাপতি দেখার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি তারপরেও একটু খেয়াল করলেই আমাদের চারপাশে অসংখ্য সুন্দর সুন্দর পাখাওয়ালা এসব পতংগের দেখা মেলে, অনেক সময় আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমাদের সামনে দিয়েই উড়ে চলে যায়!
যখনই আমরা কোন প্রজাপতি দেখি, আমাদের মনে অনেক ধরণের প্রশ্নেরই উদ্রেক ঘটে যেমন এদের এরকম রঙের কারণকি কিংবা এরা কি খায় কিংবা থাকে কোথায়! ঐ সময়ে আমাদের মনে এসব প্রশ্ন জাগলেও পরক্ষণেই ভুলে যায় কিংবা কম্পিউটারে বসে এসব জানতে যেয়ে ফেসবুকের রঙিন দুনিয়াতে হারিয়ে যেয়ে তা আর জানা হয়ে ওঠেনা! প্রজাপতি হচ্ছে Lepidoptera বর্গের এক ধরণের পতংগ পৃথিবীর বুকে যাদের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন বছর পূর্বে Eocene ইপোকে। এই বর্গের অধীনে সাতটি পরিবার আছে এবং প্রতি পরিবারেই ভিন্ন ধরণের প্রজাপতির দেখা মেলে।
প্রজাপতি ও মথের পার্থক্যঃ প্রজাপতি ও মথ উভয়েই লেপিডপ্টেরা বর্গের অন্তর্ভুক্ত হবার কারণে এদের মধ্যে যেমন অনেক মিল রয়েছে ঠিক তেমনি পার্থক্য ও রয়েছে অনেক। মজার ব্যপার হচ্ছে, এই বর্গের অধীনে বেশীরভাগ প্রজাতিই হচ্ছে মথ এবং সমগ্র পৃথিবীতে প্রজাপতিএ তুলনায় মথের প্রজাতির সংখ্যা প্রায় আটগুণ।
- প্রজাপতি দিনের বেলাতে সক্রিয় থাকলেও মথ সাধারণত রাতের বেলাতে সক্রিয় থাকে।
- মথের তুলনায় প্রজাপতি অনেক বেশি রঙিন হয় যদিও অনেক রঙিন প্রজাতির মথেরও দেখা মেলে।
- মথের অ্যান্টেনার সামনের অংশ তুলনামূলক বেশি মোটা হয়।
- মথ সাধারণত দিনের বেলাতে পাতার নীচের অংশে থাকে যার কারণে এদের দেখা মেলা ভার।
- প্রজাপতি পাখা ছড়িয়ে থাকতে বেশি পছন্দ করলেও মথ পাখা গুটিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করে।
পৃথিবীতে প্রজাপতির সংখ্যাঃ সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় ২০০০০ প্রজাতির প্রজাপতির দেখা মেলে এর মধ্যে আমাদের দেশে প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০ প্রজাতির দেখা মেলে।
প্রজাপতির জীবনকালঃ প্রজাপতি কয়দিন বাচে এইটা নিয়ে অনেকের মধ্যেই অনেক গুজব ছড়িয়েছে এবং কেও কেও মনে করেন যে মাত্র সাতদিনেই প্রজাপতির জীবনকালের সমাপ্তি ঘটে! কিন্তু না, প্রজাপতির জীবনচক্রের চারটি ধাপ শেষ হতে প্রায় এক মাস সময় লাগে অর্থাৎ এরা সাধারণত এক মাস বাচে।
প্রজাপতির জীবনচক্রঃ হঠাত করে যদি ক্লাসে স্যার কিংবা অন্য কেও Caterpillar কিংবা Pupa বলেন তাহলে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে এগুলো আবার কি, খায় না মাথায় দেয়! প্রজাপতির জীবনচক্রে চারটি ধাপ থাকে, এগুলো হচ্ছে, ডিম, ক্যাটারপিলার, পিউপা এবং পরিণত প্রজাপতি। স্ত্রী প্রজাপতি সাধারণত পাতার ওপরে ডিম পাড়ে এবং এই পাতা ঠিক করার ব্যাপারে অনেক শর্ত আছে, ডিম থেকে ক্যাটারপিলার অবস্থায় পরিণত হবার পরে ঐ অবস্থায় এদের খাদ্যের ওপরে ভিত্তি করেই মা প্রজাপতি পাতা বাছাই করে এবং ডিমগুলো আঠা জাতীয় পদার্থ দিয়ে যুক্ত থাকে যার কারণে নীচে পড়েনা। ডিম থেকে ক্যাটারপিলারে পরিণত হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগে। ক্যাটারপিলারদের বৃদ্ধির হার অনেক বেশি যার কারণে এদের অনেক খাবারের প্রয়োজন পড়ে। এরা অনবরত খেতে থাকে যার কারণে এদের বৃদ্ধি অনেক তাড়াতাড়ি হয়। ক্যাটারপিলার থেকে পিউপাতে পরিণত হতে কমপক্ষে পাঁচদিন সময় লাগে। এসময় এরা একটা ককুনের মধ্যে থাকে। পিউপা হতে পরিণত প্রজাপতিরূপে বের হতে প্রায় দুসপ্তাহ সময় লাগে। (এখানে অনেক সংক্ষেপে প্রজাপতির জীবনচক্রের ধারণা দেয়া হয়েছে, বিস্তারিত জানতে হলে ইন্টারনেট এর সাহায্য নিন।)
প্রজাপতির রঙের উৎসঃ অনেকেই হয়তো ধারণা করছেন যে, শরীরে নানান ধরণের রাসায়নিক উপাদান থাকার কারণেই এদের এরকম রঙিন পাখা থাকে! আসলে তা-না, প্রকৃত কারণ হচ্ছে আলোর বিচ্যুতি। কোন বর্ণের আলো কিভাবে বিচ্ছুরিত হবে এবং কিভাবে আমাদের আমাদের চোখে ধরা দেবে তার পুরোটাই নির্ভর করে কিসের ওপরে আপতিত হচ্ছে তার ওপরে। আলোর এই ধর্মকে iridescence বলে।
প্রজাপতির রঙের কারণঃ আমাদের বাসযোগ্য এই সুন্দর ধরণিতে যা কিছু ঘটছে সবকিছুর পেছনেই কোন না কোন কারণ রয়েছে ঠিক তেমনি প্রজাপতির এমন রঙিন পাখা থাকার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে।
- বিপরীত লিংগকে আকৃষ্ট করা।
- বিপরীত লিঙ্গের সদস্যকে চিনতে পারা।
- শিকারি প্রাণিদের হাত থেকে বাঁচা। ইত্যাদি।
প্রজাপতির নিস্ক্রিয় অবস্থাঃ আসলে নিস্ক্রিয় বললে ঠিক হবেনা কিন্তু বোঝার সুবিধার জন্য এই শব্দটি ব্যবহার করলাম। এখানে নিস্ক্রিয় বলতে বোঝানো হয়েছে কোন কাজ না করে স্থির হয়ে থাকা। আমরা সাধারণত প্রজাপতির নিস্ক্রিয় অবস্থার সাথে পরিচিত নই কারণ সবসময়েই দেখি এরা ফুলে ফুলে মধু খেয়ে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু প্রজাপতির পেছনে একটু সময় দিলেই দেখতে পারবেন যে এরা দিনের বেলাতে ছায়া পছন্দ করেনা, রৌদ্রে ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করতে থাকে, আপনি যদি এদের গায়ের ওপরে কোন কিছুর প্রতিবিম্ব ফেলার মাধ্যমে ছায়ার সৃষ্টি করেন তাহলে এরা তখনি উড়ে যাবে। কিন্তু দিনের শেষভাগে ঘটে সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা। তখন এরা গাছ কিংবা অন্য কোনকিছুর ওপরে বসে থাকে এবং শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। বিকালের শেষভাগ থেকে পরের দিন ভোর হওয়া পর্যন্ত এরা এভাবেই থাকে যার কারণে এসময় এদেরকে দেখা যায়না।
প্রজাপতির বাসস্থানঃ বিগত বেশ কিছুদিন ধরে আমার বারবার মনে হচ্ছে প্রজাপতির ঘরবাড়ি কেমন হবে, কোথায়-ই বা এরা থাকে, দিনের শেষে এরা কোথায় যায়! কম্পিউটারে বসার পূর্বে এসব কিছু মাথায় থাকে কিন্তু এই যন্ত্রের সামনে বসলেই ফেসবুকের রঙিন দুনিয়ার মাঝে হারিয়ে যায় যার ফলশ্রুতিতে এটা আর জানা হচ্ছিল না কিন্তু ২-১ দিন আগে হঠাত করে নেট খুঁজে এগুলো জানতে পারি আর এই নোট লেখার ইচ্ছা জাগে। বাসা বলতে যা বোঝায় এদের এরকম কিছুই থাকেনা। এরা সাধারণত দিনের শেষভাগ হতে পরেরদিন সকাল পর্যন্ত ইটের খাঁজে, কোন বিল্ডিঙের মাঝে, গাছের ডালে কিংবা ঝোপেঝাড়ে বসে থাকে। বিভিন্ন সরু স্থানে থাকার কারণে এদেরকে ঐ সময়টাতে দেখা যায়না।
প্রজাপতির খাবারঃ সবাইই চোখ বুজে বলে দিতে পারবেন যে সব প্রজাপতিই ফুলের মধু কিংবা গাছের রস খেয়ে থাকে কিন্তু মজার কথা হচ্ছে, পতংগ শিকারি প্রজাপতিরও দেখা মেলে। Miletinae নামক উপপরিবারের সদস্যেরা যাদেরকে সাধারণত Hervesters কিংবা Woolly Legs নামে ডাকা হয়, এরা Homoptera উপপর্বের পতংগদের শিকার করে পিঁপড়াদের সাথে মিথোজীবী সম্পর্কের সৃষ্টি করে।
প্রজাপতি সম্পর্কে তো অনেক কিছুই জানা হলো, আজ এই পর্যন্তই থাক। শেষ করার আগে আরেকটি মজার কথা জানিয়ে দেয়, প্রজাপতি কোন কিছু স্পর্শ করে স্বাদ অনুভব করতে পারে। এদের পায়ের কিনারাতে এক ধরণের কেমোরিসেপ্টর থাকে যার কারণেই এরকম সম্ভব হয়।
লেখকঃ বিভাগীয় সম্পাদক (প্রাণিজগত) , বিজ্ঞান ম্যাগাজিন- জিরো টু ইনফিনিটি