
ফিরে দেখা জলবায়ু রাজনীতি-২০১৩
বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই জলবায়ুর সাথে রাজনীতির প্রগাঢ় মিশ্রন ঘটেছে। ২০১৩ সালও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বর্তমানে জলবায়ু রাজনীতি সকল কর্মপরিকল্পনা ও নীতি-নির্ধারনীর এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২০১৩ সালের জলবায়ু রাজনীতির প্রধান অংশ জুড়ে আছে সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত IPCC(Intergovernmental panel on climate change) এর প্রতিবেদন ও নভেম্বর মাসে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে অনুষ্ঠিত UNFCC এর সম্মেলন।
২০১৩ সালের শুরু থেকেই জলবায়ু- রাজনীতির গতিবিধি বিগত বছুরের তুলনায় একটু ভিন্নরুপ নেয়। মে মাসে যখন বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড এর পরিমান ৪০০ পিপিএম ছাড়িয়ে যায় তখন বিভিন্ন বিজ্ঞানীর ভাষ্যমতে এ ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়াবহ অশনি সংকেত আর এমন ঘটনা মিলিয়ন বছর পূর্বে ঘটেছিল যখন সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ছিল ৪০ মিটারেরও বেশি এবং মেরু অঞ্চল ছিল বরফহীন । এই সতর্কবানীর পর থেকেই পরিবেশবাদী সংগঠন এবং জলবায়ু ও বৈশ্বিকউষ্ণায়নের ফলে ক্ষতির সম্মুখীন দেশসমুহ উন্নতদেশসমুহের কার্বন নিঃসরন হ্রাস করা ও ক্ষতিপূরণের জোর দাবী তুলতে থাকে। এর কিছুদিন পরই সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় IPCC এর আতংকজনক এক প্রতিবেদন। এতে দ্ব্যর্থহীনভাবে দাবী করা হয়েছে যে মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণেই বৈশ্বিকউষ্ণায়ন ঘটছে এবং টেকসইভাবে নিঃসরন না কমানো গেলে ২১০০ সাল নাগাদ বিশ্বের তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধি পাবে। IPCC সমুদ্রের অম্লত্ব বৃদ্ধি নিয়েও একটি গবেষনা পত্র প্রকাশ করে যাতে বলা হয় ব্যাপকহারে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষনের ফলে সমূদ্রের অম্লত্ব অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের প্রাণীকুল বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সংস্থাটি ২১০০ সালনাগাদ সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ২১-২৬ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করছে। এ প্রতিবেদন প্রকাশের পরই বিভিন্ন উন্নত দেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের গবেষণা কেন্দ্রসমূহ প্রতিবেদনটিকে ত্রুটিপূর্ণ বলে দাবী করে। তারা উল্লেখ করে যে, বৈশ্বিকউষ্ণায়নের জন্য শুধুমাত্র মানুষই দায়ী নয় এবং তারা এক্ষেত্রে বিগত ১০ বছরের গবেষণার রেকর্ড তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ তারা উত্তরমেরুর বরফচাদরের পুনরাবির্ভাব ঘটনাকে তুলে ধরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে IPCC এর বিভিন্ন সদস্য দেশ সংস্থাটির গবেষণা পদ্ধতি এবং নীতি নির্ধারনীর পরিবর্তন দাবী করে।
তবে এ সকল সংশয়ের অবসান হয় নভেম্বরে পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত UNFCC এর সভায়। সেখানে এক হাজার পৃষ্ঠার এক গবেষনাপত্র সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করে যে ৯৭ শতাংশ বৈশ্বিকউষ্ণায়ন হয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট কারণে এবং এ সভায় ২০১৫ সালের ডেডলাইনকে স্থির করে করণীয় নির্ধারণ করা হয়। ২০১৩ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত কিছু বিতর্কিত মন্তব্য করেন অষ্ট্রেলিয়ার নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবেট ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। তারা জলবায়ু পরিবর্তনের দাবীকে অযৌক্তিক ও বানোয়াট হিসেবে আখ্যা দেন। এমনকি অষ্ট্রেলিয়া UNFCC সম্মেলনে কোন প্রতিনিধি পর্যন্ত প্রেরন করে নি। উক্ত কর্মকান্ড বিশ্বমহলে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে।
২০১৩ সালে প্রকৃতঅর্থে জলবায়ু পরিবর্তনরোধে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় বিশ্ববাসী। এই বছর বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিপূরণ প্রার্থীদেশসমূহের দাবী ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ২০১০ সালের কোপেনহেগেন সম্মেলন কিংবা ২০১২ সালের রিও প্লাস টুয়েন্টির মত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের উপস্থিতি ও দাবী এতটা সপ্রতিভ না হলেও ২০১৩ সালে বাংলাদেশ একেবারে ব্যর্থ নয়। তবে দিনের শেষে বলতেই হয় যে বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক ডামাডোলে ক্ষতিপূরণের দাবীটি অনেকটাই চাপা পড়েছে। তবে আশার কথা এই যে, চীন ও যুক্তরাষ্টের মতো কার্বন নিঃসরনকারী দেশসমূহ কার্বন নিঃসরন কমানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে এবং যুক্তবাজ্য ও অষ্ট্রেলিয়া ব্যতীত অন্য কোন দেশ ক্ষতিপূরণের দাবী সরাসরি বিরোধিতা করে নি।
লেখাটি জনপ্রিয় বিজ্ঞান ম্যাগাজিন জিরো টু ইনফিনিটি’র ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত।