ফুকুশিমা প্রসঙ্গঃ অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ

ফারজানা হালিম নির্জন 

দেখতে দেখতে সময়তো কম গেলোনা। আজ পাকাপাকিভাবে তিন বছরে পা দিলো জাপানের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সেই অতি-ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাটি। ছিমছাম,গোছালো ফুকুশিমা শহরটি পৃথিবীর অন্য সব পরিকল্পিত শহরের মতই। চোখ জুড়ানো নদী,হ্রদ,সুন্দর কাঠামোর তৈরী অফিস-আদালত,পাহাড়ের কোল ঘেষে ছুটে চলা ট্রেন,সবুজ আর নীলে ঢাকা এই চমৎকার দৃশ্যগুলো হয়তো চিরদিনের জন্যই চাপা পড়ে গেলো ফুকুশিমার মানচিত্র থেকে। জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন গুগল.কম এ গিয়ে ফুকুশিমা পর্যন্ত লিখতে না লিখতেই সে নিজে থেকেই ঝুলি থেকে বের করে দেবে ফুকুশিমার হাজারটা ধ্বংসের খবর আর যান্ত্রিক পর্দা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে সেইসব খবরে। ২০১১ সালের ১১ই মার্চের ভয়াবহ ভূমিকম্প,ভূমিকম্প পরবর্তী সুনামি আর সুনামির ক্ষীপ্র আঘাতে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র ধ্বংসের খবর। আজ থেকে তিন বছর আগে কী হয়েছিলো সেদিন সেখানে?ocean-contamination

পৃথিবীর ইতিহাসে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ধ্বংসের যত কাহিনী আছে,তার মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ হলো রাশিয়ার চেরনোবিল আর জাপানের ফুকুশিমার দুর্ঘটনা। ফুকুশিমার দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সমুদ্রের তীর ঘেষে তৈরী করা। কে জানতো,ফুকুশিমাকে ঘিরে সেদিন একসাথে এতোগুলো দুঃসংবাদ আগে থেকেই তৈরী হয়ে ছিলো! সেদিন হঠাৎ করেই সেখানে ভূমিকম্প আঘাত হানলো,ভূমিকম্প সাথে করে নিয়ে এলো সুনামিকে। সাজানো-গোছানো সংসার,বাড়ি-ঘর,মানুষ,গাড়ি-ঘোড়া,রাস্তা,গাছ-পালা সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে দিয়ে পুড়ে নিলো নিজের পেটের ভেতর। প্রেতাত্মার রূপধারী সুনামি সমুদ্রের  ঢেউয়ের উপর ভর করে দেখা দিয়েছিলো সেই ১১ই মার্চ,২০১১ সালে। অবুঝ শিশুদের মত বেঁচে থাকা অসহায় মানুষেরা চোখের সামনে এই ঝক্কি দেখতে না দেখতেই ঘটনা রুপ নিলো আরো ভয়াবহতায়। জাপানের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো একটি খবর,সুনামীর তীব্রতার কারণে ফুকুশিমার পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লী নাকি জায়গায় জায়গায় ফুঁটো হয়ে গেছে। এর ফলাফল কী হতে পারে তা আর কারো বুঝতে বাকি রইলো না। জ্বালানী হিসেবে ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যাবহার করা হয় ইউরেনিয়াম অক্সাইড। ২৮০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি গলতে পারে। এই অতি শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় পদার্থটি সংরক্ষন করে রাখা হয় ৬ টি প্রতিরোধক ব্যাবস্থার মাধ্যমে,যাতে তা কোনো উপায়ে পরিবেশের সাথে মেশার সুযোগ না পায়। পারমাণবিক চুল্লী যখন চালু থাকে,তখন এই ইউরেনিয়াম অক্সাইড ভেঙ্গে বিভিন্ন উপায়ে তৈরী হতে থাকে আরো অসংখ্য তেজস্ক্রিয় পদার্থ।  সুনামি আঘাত হানতে পারে,এই ধারণা মাথায় রেখে তারা চুল্লীর নকশা তৈরী করেননি। এটি ছিলো সবচেয়ে বড় ঘাটতি। ভূমিকম্প আঘাত হানার আগেই পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু তখনও নিউক্লিয়ার রি-অ্যাক্টরে জ্বালানী তাপ উৎপন্ন করতে থাকে। একে ঠান্ডা রাখার জন্য ব্যাক-আপ কুলিং সিস্টেম দিয়ে চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু সেই ব্যাক-আপ কুলিং সিস্টেমের ব্যাক-আপ ব্যাটারীর প্রয়োজন হয়,যার আয়ুষ্কাল কিনা আবার মাত্র আট ঘন্টা! তাই জ্বালানী থেকে তাপ উৎপন্ন করার প্রক্রিয়াটি বন্ধ করতে এই পদ্ধতি খুব বেশি কাজে লাগানো যায়নি। তাই কুলার হিসেবে তাৎক্ষনিকভাবে ব্যাবহার করা হয় সমুদ্রের পানি। কিন্তু সমুদ্রের পানিতে লবণসহ যে অবিশুদ্ধ উপাদানগুলো থাকে,তা উলটো তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে দিতে বেশ ভাল ভূমিকা রাখতে পারে ভেবেও এটি করা হয়েছিলো। যেহেতু রি-অ্যাক্টর পুরোপুরি ঠান্ডা করার আর কোনো উপায় ছিলোনা। অতঃপর,তৈরী হতে শুরু করে বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ,প্রতিরোধক মাধ্যম গুলো ভেঙ্গে যায় সুনামির ভয়াবহতায়,ফলস্বরূপ বাতাসে আর পানিতে ছড়িয়ে পড়ে তেজস্ক্রিয় পরমাণু আর সেই সাথে এক্স-রে,গামা-রে’র মত ক্ষতিকর রশ্মিগুলো। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী তেজস্ক্রিয় পরমাণু মানুষ তার পুরো জীবনকালে যতখানি গ্রহণ করে সেটি খুবই অল্প পরিমাণ এবং সহণীয়। কিন্তু সেই তেজস্ক্রিয় পরমাণু যদি কৃত্রিম উপায়ে তৈরী করা হয়,আর সেটি যদি পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে,তবে তা খুবই ক্ষতিকর ভূমিকা রাখতে পারবে নিঃসন্দেহে। ক্যান্সার থেকে শুরু করে মৃত্যুর কারণ তৈরী করতে সে একাই যথেষ্ট। ২০১১ সালের ১১ই মার্চ এই ভয়াবহ ঘটনাটিই ঘটে গিয়েছিলো ফুকুশিমায়। মর্মান্তিক অনেক কাহিনী দেখতে হয়েছে বিশ্ববাসীকে। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও ১৯-২০ এর তরুণ থেকে ৭০-৭৫ বছর বয়সের বৃদ্ধরা এগিয়ে গেছেন তেজস্ক্রিয়তার নিঃসরণ কমানোর জন্য চুল্লীর একেবারে নিকটে কাজ করতে। তাদের মনে হয়তো ছিলো একটাই আশা,তাদের জীবনের বিনিময়ে রক্ষা পেতে পারে তাদের পরিবার,তাদের দেশ,তাদের বিশ্ব। অনেকেই লাশ হয়ে ফিরে এসেছেন। আর অগুণিত কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় পরমাণুতো এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে ফুকুশিমার আকাশে বাতাসে।fukushima
আকাশ-বাতাসের কথা শেষ হলো,বাকি রইলো আরো একটি বাহন-মাধ্যম। পানির কথা বলছি। সেদিন থেকেই সমুদ্রের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয় পরমাণুগুলো রওনা হয়ে গেছে,বিশ্বের অন্যদেশগুলো কুড়ে কুড়ে খাওয়ার জন্য। আর যাওয়ার পথে সমুদ্রের মাছ সহ অন্য প্রাণিদেরতো ক্ষতি করছেই। ফুকুশিমায় পাওয়ার-প্ল্যান্টের গা ঘেষে সী-ওয়াল ছিলো,কিন্তু তা একই সাথে ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাত থেকে রক্ষা পেতে যথেষ্ট ঊঁচু কিংবা মজবুত ছিলোনা। সবকিছুই মোটামুটিভাবে বলা হলো,কিন্তু এতো বড় বিষয়টাতে রাজনীতির হাত থাকবেনা,এটাও তো হতে পারেনা। ফুকুশিমা দুর্ঘটনার শুরু থেকেই জাপান সরকার এতো বড় দুর্ঘটনাটিকে যেন সব ক্ষেত্রেই পরিশেষে একটু হালকা ভাবেই দেখছেন । যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞরা বলছেন ফুকুশিমা পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে মানুষজন কে  ৫০ কি.মি দূরে যেতে,তো জাপানের অভিজ্ঞরা বলছেন ২০ কি.মি দূরে যেতে। অথবা তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব নিয়ে মানুষজন উদ্বিগ্ন হচ্ছেন,তো জাপান সরকার বলছেন এটা তেমন কিছুনা। অনেকটা ছোট বাচ্চাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখার মতই যেন সান্ত্বনা দেবার মত আচরণ দেখিয়ে মনে মনে কিছু একটা ফন্দী আটছেন। তিন বছর অতিক্রম হয়ে গেলেও,রাশিয়ার সেই চেরনোবিলের মতই যেন নির্বিকার ভাবে ফেলে রাখা হয়েছে ফুকুশিমার বিষয়টিকেও। ক্ষয়-ক্ষতি আর কতদূর এগুলে তাঁদের টনক নড়বে,সে নিয়ে চিন্তিত ফুকুশিমার পাশাপাশি জাপানের মানুষজন। বাবা-মা’য়েরা এখনো তাদের সন্তানদের বাইরে খেলতে দিতে চাননা। নিতান্ত প্রয়োজনে মাস্ক পড়ে বাইরে বের হন। আর শিশুদের খেলার মাঠ এখন তাদের ঘরের ড্রয়িংরুম। এই ক্ষুদ্রবিষয়গুলোও যে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে কত বড় পরিবর্তন আনতে পারে,কিংবা এনেছেও,তা নিয়েও উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা। এছাড়া এটি পরীক্ষিত,ফুকুশিমার অধিকাংশ শিশুই এখন লড়াই করছে থাইরয়েড ক্যান্সারের সাথে। আর জাপান সরকার পুরো বিষয়টিকে হয়তো হালকাভাবেই উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। যদি আরো একবার পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরী করা যায়! কিন্তু গোটা বিশ্ববাসীই এমন ভয়ংকর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না,যা কিনা এমন দীর্ঘমেয়াদী ভয়াবহ স্মৃতিচিহ্ন রাখার সাজসজ্জা পরেই প্রস্তুত হয়।fish fukushima

চেরনোবিল-ফুকুশিমা প্রসংগ শেষ করে এবার নিজের দেশের দিকে একটু নজর দিতে ইচ্ছে করছে। জাপান,রাশিয়া ধনী দেশ। তাদের এলাকায় যা কিছু তৈরী করা হয়,তা যথেষ্ট পরিমাণে পরিবেশ প্রতিরোধক মালামাল দিয়েই তৈরী করা হয়। তবু দু-একটি ছোট্ট ভুলের কারণে তারা আজ এতো বড় হুমকির মুখে ছেড়ে দিয়েছে নিজেদের,এমনকি পুরো বিশ্বকেই। কিন্তু বাংলাদেশের মত ছোট্ট আর গরিব দেশে,রামপালে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে,তা ভবিষ্যতে কতটুকু ঝক্কি সামলাতে পারবে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে? বাংলাদেশ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দেশ। হয়তো ছোট্ট একটি বিপর্যয়ের হাত ধরে সমগ্র বাংলাদেশকে ছিনিয়ে নিতে পারে আরেক প্রেতাত্মা রুপধারী কোনো সর্বনাশি বিপর্যয়। আর তার সূত্রপাত যে রামপাল থেকে হবেনা,এটা ক’জন নিশ্চিতভাবে বলতে পারে?

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics