বটবৃক্ষের বন্ধু
রাজীব নূর ও মাসুদ আলম, অভয়নগর (যশোর) থেকে
১৯৭১ চলছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন দেশের সূর্যসন্তানেরা। জীবন বাজি রেখে অনেকেই নানাভাবে সহায়তা করছেন তাঁদের। আবার অনেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দেশ ছেড়ে ছুটছেন ভারতে।ঠিক এমনই এক সময়ে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার তারুয়াপাড়া গ্রামের একটি হিন্দু পরিবার ভারতে যাচ্ছিল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের বিশাল বটগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে পরিবারের সদস্যরা সমবেত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বটগাছটার দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করলেন, ‘আশীর্বাদ করো, দেশ স্বাধীন হলে ফিরে এসে যেন আবার তোমাকে পুজো দিতে পারি।’পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন পানের বরজের দিনমজুর তরুণ সাদিক আসগর। ভাবলেন, গাছ কি মানুষের কথা বোঝে! বিস্ময়ের ঘোর কাটে না কিছুতেই সাদিকের। ভীষণ আপ্লুত হলেন তিনি। বাড়ি ফিরে এসে ঘটনাটি লিখে ফেললেন খাতায়। একটি কবিতাও লিখলেন সদ্য দুচোখে দেখা ঘটনা নিয়ে। কিন্তু তাতেও মন ভরল না তাঁর। সিদ্ধান্ত নিলেন গাছ লাগাবেন। সেই থেকে শুরু তাঁর গাছ লাগানো।
বটবৃক্ষের বন্ধু: বটগাছ দিয়েই শুরু। তবে কিছুদিন না যেতেই তিনি অন্যান্য গাছও লাগাতে শুরু করেন। গত চার দশকে হাজার খানেক গাছ লাগিয়েছেন তিনি। তবে বটই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। এলাকাবাসীও তাঁকে ডাকেন ‘বটবৃক্ষের বন্ধু’ বলে। বটগাছের প্রতি পক্ষপাতের কথা অকপটে স্বীকার করে সাদিক আসগর বললেন, সেই ১৯৭১ সাল থেকে তাঁর মনে একটা বিভ্রম তৈরি হয়েছে, প্রায়ই তাঁর মনে হয় তিনি বটগাছের কথা শুনতে পান। বটগাছও বুঝতে পারে তাঁর মনের আকুতি। ভালোবাসার এমন প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাদিক ওই গ্রাম-জনপদে নিজেই এক মহিরুহে পরিণত হয়েছেন। এ মানুষটির কথা আমরা জানতে পাই তাঁর পাশের গ্রাম ধলিরগাতীর মো. মফিজউদ্দিনের কাছ থেকে। মফিজ জানান, কোনো স্বীকৃতির কথা না ভেবে গাছ লাগিয়ে চলেছেন সাদিক। অভয়নগর উপজেলায় এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুর্লভ, যেখানে তিনি একটি গাছও লাগাননি। নদীর পাড়, রাস্তার ধার সর্বত্র দিনের পর দিন গাছ লাগিয়ে চলেছেন মানুষটি।
মফিজের দেওয়া ঠিকানা ধরে গত ১৯ জুলাই অভয়নগরের এক প্রান্তে অবস্থিত জিয়াডাঙ্গা গ্রামে সাদিক আসগরের বাড়িতে পৌঁছে জানা গেল, তিনি কবিতা কম্পোজ করতে গেছেন পাশের ঢাকুরিয়া বাজারে।
সাদিক মুঠোফোন ব্যবহার করেন না বলে তাঁকে খুঁজতে ঢাকুরিয়া বাজারেই যেতে হলো। জিয়াডাঙ্গা থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের ঢাকুরিয়া অভয়নগরের পাশের উপজেলা মনিরামপুরের বর্ধিষ্ণু একটি গ্রাম। গ্রামের বাজারটিও বেশ বড়। তাই সাদিককে খুঁজতে এ দোকান ও দোকানে জিজ্ঞাসা করতে হয়। গৌতম চক্রবর্তী নামের এক দোকানি চিনতে পারেন, তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাল্টা জানতে চান, ‘গাছপাগলা কবিকে খুঁজছেন নাকি?’ দু-এক কথার পর গৌতম রাস্তার অন্য পাড়ে একটি বকুলগাছ দেখিয়ে বলেন, ওই গাছটিও সাদিক আসগরের লাগানো। সাদিকের কাছে তাঁর লাগানো গাছগুলোও সন্তানের মর্যাদা পায়। গৌতম নিজেই দেখেছেন ওই বকুলগাছটিকে কী গভীর মমতায় বড় করেছেন সাদিক। এখনো ঢাকুরিয়া বাজারে এলে গাছটিকে ছুঁয়ে আদর করে যান।
সাদিকের জীবনসংগ্রাম: অবশেষে সাদিক আসগরের দেখা মিলল। সাধারণ একটি লুঙ্গির সঙ্গে পরেছেন সাদা একটি পাঞ্জাবি। পায়ে চপ্পল। মাথায় টুপি। আলাপচারিতার একপর্যায়ে ১২ সন্তানের জনক সত্তরোর্ধ্ব এই মানুষটি জানালেন তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা। তিন ভাই ও নয় বোনের মধ্যে তিনি নবম। মাত্র আট বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ ঘটলে সন্তানদের লালন-পালনের ভার বর্তায় মায়ের ওপর। সাদিক প্রথমে পাশের গ্রাম ধলিরগাতীর মক্তবে এবং পরে মাগুরাহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মায়ের মৃত্যুর কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীতেই থেমে যায় তাঁর পড়াশোনা। এরপর সেই শৈশবে ট্রেনে-বাসে পান-বিড়ি বিক্রি করেছেন। কাঠ চেরাই করা, মাছ বিক্রি করা, পানের বরজে মজুরি খাটা, তাঁত বোনা, মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করার মতো বহু বিচিত্র কাজ করতে হয়েছে একসময়। ১৯৭২ সালের শেষদিকে এসে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগে টিউবওয়েল মিস্ত্রির চাকরি পেলেন। সেই থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন অভয়নগরের গ্রাম-গ্রামান্তরে।
একজন কবিও: ২০০৬ সালে চাকরি থেকে অবসরের পর কবিতা লেখাটা ধ্যানের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করেছেন সাদিক। কবিতা লেখা আর গাছ লাগানো দুটি কাজে একসঙ্গেই হাত দিয়েছিলেন তিনি। কঠিন জীবনযুদ্ধের কারণে মাঝেমধ্যে কবিতা লেখায় ছেদ পড়লেও গাছ লাগানো থামেনি কখনো। অবশ্য এরই মধ্যে ছন্দমালা ও নীতিকথা, করুণ কারবালা, বাঁশের বাঁশি ইত্যাদি গোটা দশেক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। সাদিকের ছেলে এম এম কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র কুতুবউদ্দিন বলেন, বাবাকে গ্রামের মানুষ ‘আরেকজন পল্লিকবি’ বলে ডাকে। এতেই তিনি আনন্দিত হন।
মানুষের জন্য: কোন কাজটা বেশি পছন্দ—জানতে চাইলে সাদিক আসগর যেন একটু বিচলিত বোধ করেন। তবে একটু পরেই বলেন, ‘কবিতা লিখি নিজের জন্য। গাছ লাগাই মানুষের জন্য। তবে কবিতা পড়ার পর কেউ যদি বলে ভালো লেগেছে, খুব আনন্দ হয়। একই রকম আনন্দ হয়, যখন দেখি আমার লাগানো গাছতলায় বসে জিরিয়ে নিচ্ছে ক্লান্ত পথিক। গাছগুলোতে বাসা বানাচ্ছে পাখি ও পতঙ্গরা।
সাদিক জানালেন, বিদেশি গাছ তিনি লাগানই না। কারণ, ওই সব গাছে আমাদের পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। বট ও বকুল—এ দুটি গাছ তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। বকুলের চারা পাওয়া গেলেও সাধারণভাবে বীজ থেকে চারা হয় না বলে বটের চারা পাওয়াটা খুবই কঠিন। তাই ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে চেষ্টা করে মাত্র ৩২টি বটগাছ বড় করতে পেরেছেন।
বটের চারা জন্মানোর এ বিষয়টি জানা ছিল না আমাদের। তাই যোগাযোগ করি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক এ এফ এম জামালউদ্দিনের সঙ্গে। জামালউদ্দিন বলেন, পাখি বটের ফল খেয়ে মল ত্যাগ করার পর বটের বীজ অঙ্কুরোদ্গমের উপযোগী হয়। তবে যেখানে সেখানে বটের চারা হয় না। বটের বীজ থেকে চারা হওয়ার মতো প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা আছে এমন কোনো জায়গা (পুরোনো ভাঙা দেয়াল, অন্য গাছের খোঁড়ল) পেলেই বটের চারা হয়।
সাদিক আসগর যেখানেই বটের চারা পান, সেটাই তুলে আনেন তিনি। এখনো তাঁর সংগ্রহে রয়েছে চারটি বটের চারা।
এ পর্যন্ত দুই শতাধিক বকুলগাছ লাগিয়েছেন সাদিক। বকুলগাছ লাগানোর জন্য তাঁর পছন্দ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ পর্যন্ত তিনি যশোরের ৮৩টি কলেজে বকুলগাছ লাগিয়েছেন। নিজের গ্রাম জিয়াডাঙ্গার ঈদগাহ মোড়ের দুদিকে চারটি বকুলগাছ দেখিয়ে সাদিক বলেন, গ্রামের লোকজন এখন এ মোড়টাকে বকুল মোড়ও ডাকে।
সাদিক বলেন, মৃত্যুর আগে যশোরের সব কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত একটি করে গাছ লাগিয়ে যেতে চান। তাঁর বিশ্বাস, তিনি না থাকলেও ছেলে কুতুব তাঁর এ স্বপ্নটা পূরণ করবে।
সাদিক জানান, তাঁর লাগানো শ খানেক আমগাছ আছে গাবুখালী মাগুরা কলেজে। বাহেরঘাট মাদ্রাসায় আছে ৫০টির মতো কাঁঠালগাছ। লাউকুণ্ডা মাদ্রাসায় আছে ৫০টির মতো নারকেলগাছ। লাগিয়েছেন জাম, কৃষ্ণচূড়া, তেঁতুল, মেহগনিও।
মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি: জিয়াডাঙ্গা গ্রামটি যে ইউনিয়নে, সেই প্রেমবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, অভয়নগর, মনিরামপুর ও কেশবপুরের রাস্তাঘাটে অজস্র গাছ সাদিক আসগরের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যার সংখ্যা স্বয়ং সাদিকেরই জানা নেই। তিনি বলেন, সাদিক গাছ লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষায় যে ভূমিকা রেখেছেন, তা দেখে এলাকার অনেক তরুণই অনুপ্রাণিত হয়েছেন। প্রেমবাগ ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের সর্বত্রই এখন এমন অনেক স্বেচ্ছাব্রতী তরুণের দেখা পাওয়া যাবে, যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে গাছ লাগানোর কাজ করছেন। সিরাজুল মনে করেন, এলাকাবাসীর ভালোবাসার মধ্য দিয়ে সাদিকের মূল্যায়ন হয়েছে। তবে এমন একজন মানুষকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
ফিচারটি ০৩/০৮/২০১৩ এ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত