বনরুই : কুসংস্কার ওদের বাঁচতে দিচ্ছে না
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
শত্রু“র ভয়ে ভীত অবস্থায় হঠাৎ দেখে বোঝা মুশকিল যে এটা কোনো প্রাণী না গোলাকার বস্তু! কেননা শত্রু“র আক্রমণের শঙ্কা জাগলেই ওরা দেহটাকে কুণ্ডলী পাকিয়ে তার ভেতরে মাথাটাকে সযত্নে লুকিয়ে ফেলে। তার ওপর দিয়ে লেজটাকে টেনে পিঠের ওপর শক্ত করে আটকায়। আত্মরক্ষার্থে এভাবে সহজেই তারা একটি কুণ্ডলী বা চাকতি তৈরি করে ফেলে। বাঘ, কুমির বা অন্য কোনো হিংস্র জন্তুর পক্ষেও আর সম্ভব হয় না ওই কুণ্ডলী বা চাকতি ভেঙে টেনে সোজা করা। এমনকি কখনো পরিস্থিতি খানিকটা জটিল হয়ে উঠলে টিলা, বন বা পাহাড়ের গা বেয়ে কুণ্ডলী পাকানো অবস্থায়ই মুহূতের মধ্যে দ্রুত সে গড়িয়ে নেমে যেতে পারে।
আলোচিত প্রাণীটি ‘বনরুই। পার্বত্য এলাকায় এদের বলা হয় পাতালপুরীর মাছ। ইংরেজি নাম Pangolin। দেখতে সরীসৃপ গোত্রভুক্ত প্রাণীর মতো মনে হলেও এরা আসলে স্তন্যপায়ী। শরীরজুড়ে রুই মাছের মতো আঁশ ছড়ানো- মাথা থেকে একেবারে লেজ পর্যন্ত। বিচিত্র এই প্রাণী নিজ চোখে দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকেরই নেই। এদের দাঁত নেই। লম্বা আঠাল জিহ্বার সাহায্যে খাবার শিকার করে এরা। বনরুই আমাদের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য উপকারী একটি প্রাণী। এরা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। সিলেট, সুন্দরবন, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামে গভীর জঙ্গলে এদের বসবাস। এশিয়া ও আফ্রিকার উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের বনাঞ্চলেও পাওয়া যায় এদের। ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী আইনে এটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় ; মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে প্রাণীটি নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। লোকজ ওষুধ তৈরি বা টোটকার দোহাই দিয়ে হাটবাজারে হামেশাই পসরা সাজিয়ে বসে থাকা ভণ্ড কবিরাজ ও গণক আর ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অনেকে নিরীহ প্রাণীটির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে হারবাল ওষুধ তৈরির কিছু হাতুড়ে কম্পানিরও। প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনরুইয়ের দেহ দিয়ে তৈরি করা এসব ওষুধের বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই। এগুলো আসলে অপচিকিৎসা এবং অসচেতন মানুষকে বিভ্রান্ত করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার একটি কৌশল। এভাবেই বিপন্ন হয়ে পড়ায় প্রাণীটি এখন ‘আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের’ (আইইউসিএন) তালিকাভুক্ত। এ ছাড়া আমাদের দেশ থেকে এই বিলুপ্তপ্রায় বনরুই মিয়ানমারসহ পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পৃথিবীতে আট প্রজাতির বনরুই রয়েছে। বাংলাদেশে একসময় তিন প্রজাতির বনরুই দেখা গেলেও বর্তমানে দু’টি প্রজাতি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এরা হলো ভারতীয় বনরুই ও চায়না বনরুই। ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে Indian Pangolin (Manis crassicaudata) ও Chinese Pangolin (Manis pentadactyla)। দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতিটি ছিল সর্ববৃহৎ- এশীয় বৃহৎ বনরুই; Asian Giant Pangolin (Manis paleojavanica)। প্রাণিকুলের মধ্যে এরাই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যাদের শরীর আঁশযুক্ত। দেহাবরণ আঁশযুক্ত শক্ত খোলস দিয়ে আবৃত, যা অনেকটা রুই মাছের আঁশের মতো। গায়ের রং লালচে গোলাপি। তবে আঁশের রং মেটে-হলদে।’
ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বনরুই নিশাচর প্রাণী। রাতে বন-জঙ্গলে বিচরণ করে বেড়ায়। এরা তীক্ষ্ম নখের সাহায্যে এক থেকে দেড় মিটার পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে ভূগর্ভস্থ পোকামাকড়, উইপোকা ও পিপীলিকা শিকার করে খায়। পিঁপড়া প্রিয় খাদ্য। দ্রুততার সঙ্গে গাছ বেয়ে ওপরে উঠে এরা খাবার শিকার করতে পারে। লম্বা জিহ্বা পিঁপড়া বা পোকামাকড়ের ওপর নিক্ষেপ করে মুখে টেনে নেয়। মাটির গর্তে অথবা গাছের কোটরে বাস করে। দিনে গর্ত থেকে খুব একটা বের হয় না বলে সাধারণত কারো নজরে পড়ে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রজাতি ভেদে বনরুইয়ের আকৃতি বিভিন্ন হয়ে থাকে। পুরুষ বনরুইয়ের দৈহিক আকৃতি মহিলা বনরুইয়ের চেয়ে বড়। ৩০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ওজনে দুই থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত হয়। ১২০ থেকে ১৫০ দিনের মধ্যে বাচ্চা প্রসব করে। এশিয়া অঞ্চলের বনরুই এক থেকে তিনটি বাচ্চা দেয়। তবে আফ্রিকা অঞ্চলের বনরুই একটির বেশি বাচ্চা প্রসব করে না। জন্মকালে বাচ্চার ওজন ৮০ থেকে ৪৫০ গ্রাম হয়ে থাকে। দুই বছরে পরিপক্ব হয়ে ওঠে এরা। তখন দেহের আঁশগুলোও শক্ত হয়ে যায়। এরা প্রায় দুই দশক পর্যন্ত বেঁচে থাকে।’
অস্তিত্ব সংকটের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বনরুইকে বাঁচাতে হলে গণসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই। পাশাপাশি দরকার সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর দ্রুত বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
biswajit.bapan@gmail.com
সূত্র : ২৮ নভেম্বর ২০১৩ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন