বাংলাদেশের ডলফিন

আজিজুর রহমান

Plataniste or Ganges river dolphin, Bangladeshবাংলাদেশের নদ-নদীতে বসবাসকারী অতি পরিচিত শুশুকই হচ্ছে এক প্রজাতির ডলফিন। এরা জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদের বৈজ্ঞানিক নাম Platrisa gengetica. ইংরেজি নাম Ganges river dolphin, Ganges susu. আর প্রমিত বাংলায় এদের বলা হয় গাঙ্গেয় শুশুক। বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কুশিয়ারা, কর্ণফুলি, সাঙ্গুসহ প্রায় নদ-নদীই এদের বিচরণ ক্ষেত্র। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাঁধ তৈরি, বড় বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদী খনন, নদ-নদীর নাব্য হ্রাস ও দূষণ, শিকার এবং মাছ ধরার সরঞ্জামে আটকে পড়া ইত্যাদি নানা কারণে গাঙ্গেয় শুশুক বা ডলফিন এখন উপকূলীয় এলাকা বিশেষ করে সুন্দরবনের নদ-নদীকে বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশে ৮ প্রজাতির ডলফিন রয়েছে। এগুলো হলো গাঙ্গেয় শুশুক বা ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন, পাখনাহীন পরপয়েস ডলফিন, গোলাপি ডলফিন, থেবরা দাঁত ডলফিন, বোতল নাক ডলফিন, চিত্রা ডলফিন ও ঘূর্ণি ডলফিন। আছে ব্রিডিস তিমি। এছাড়া স্পার্ম হোয়েল ও ফলস কিলার তিমি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলে গবেষকরা জানান। ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস) ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব ভাগের প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাকে মিঠা পানির ২ প্রজাতির ডলফিনের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করে। যেখানে সুন্দরবনের মোট ডলফিনের প্রায় অর্ধেকের আনাগোনা আর ইরাবতী ডলফিনের এক-চতুর্থাংশের বসতি। গোলাপ ডলফিনকে কখনো কখনো এবং পাখনাহীন পরপয়েস ডলফিনকে প্রায়ই সুন্দরবনের নদ-নদীতে দেখা যায়। গাঙ্গেয় শুশুক বা ডলফিন সুন্দরবনের উজানের দিকে বিচরণ করে। অন্যদিকে, ইরাবতী ডলফিন বিচরণ করে সুন্দরবনের দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিম পার্শ্বে ৯০০ মিটার গভীর একটি গিরিখাত রয়েছে। যা সুন্দরবনের দক্ষিণে বাংলাদেশের উপকূলের খুব কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত। একে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বা সাগরের অতলস্পর্শী বলা হয়। এই সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড  জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের উপযোগী পুুষ্টি উপাদানে ভরপুর। তাই এখানকার ডলফিন তুলনামূলক সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। ২০০৪ সালে সমগ্র উপকূলীয় এলাকায় ডলফিন জরিপে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, এখানে পাখনাহীন পরপয়েস ডলফিনের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৫০০টি। এছাড়া গোলাপ ডলফিনের একটি বড় সংখ্যা আছে এখানে। আর বোতল নাক ডলফিন রয়েছে ১ হাজার ১৫০টির মতো। তবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সারা পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ইরাবতী ডলফিন যার সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার। এ তথ্য পাওয়ার পর আইইউসিএন ইরাবতী ডলফিনকে মহাসংকটাপন্ন তালিকা থেকে বিপন্নের তালিকায় নিয়ে এসেছে। সুন্দরবনের বৈচিত্র্যময় বাস্তুব্যবস্থা ডলফিনসহ সব জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী বিকাশের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। কিন্তু একশ্রেণীর মানুষের অপরিণামদর্শী কাজের জন্য এদের খাদ্য সংকট সৃষ্টি আবাসস্থল ধ্বংসসহ জনবসতি থেকে আসা দূষণ, উজানে বাঁধ নির্মাণের কারণে ঊর্ধ্বস্রোতীয় এলাকা থেকে মিঠা পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে উপকূলীয় ডলফিন। এছাড়া পূর্ব সুন্দরবনের ডলফিনের হটস্পটগুলোয় সম্প্রতি যোগ হয়েছে কার্গো ও অয়েল ট্যাংকারের যাতায়াত ফলে নদীর পার ভাঙন, শব্দদূষণ, বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য নিঃসরণ নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় নেতিবাচক প্রভাবে সামুদ্রিক প্রতিবেশ ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার ঝুঁকিতো আছেই। এসব কারণেই মূলত বাংলাদেশের জলভাগে ডলফিনের দীর্ঘস্থায়ীভাবে টিকে
থাকবে আশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। তবে সুখবর হচ্ছে, মিঠাপানির বিপন্ন ডলফিনের টিকে থাকার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সম্প্রতি সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলীয় ঢংমারী, চাঁদপাই ও দুধমুখী চ্যানেলকে সরকার অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে।

সূত্রঃ দৈনিক মানব কণ্ঠ ৩০/০৬/২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics