বাংলাদেশের বক
সুপ্রিয়া সরকার
ছোট্ট বেলায় সেই প্রথম শ্রেণীর বইয়ে কানি বকের ছড়া দিয়ে আমাদের শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল। এখনও সেই পাঠ,সেই ছড়া অব্যাহত আছে, আছে স্মৃতির গভীরে। এখনও আমরা বাচ্চা কাচ্চাদের আদর দিতে সেই ছড়া আওড়াই। আমাদের সংস্কৃতি নানাভাবে, নানা ঢং আর ছন্দে তুলে আনে আমাদের বক পাখিকে। গ্রামের জলাধারের পাশে নুয়ে পরা গাছের ডালে, কিংবা খাল, বিল, আর নদীর ধারের কাদায়, হঠাৎ চোখের নিমিষে, আমাদের বকেরা হয়তো ডানা মেলে উড়ে যায় দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে। কিন্তু, কেমন আছে আমাদের কানি বক, ধলপেট বক আর হলদে বকেরা?? চলুন জেনে নেয়া যাক আমাদের দেশের বক নিয়ে কিছু তথ্য।
বক Ardeidae গোত্রের অন্তর্গত লম্বা পা বিশিষ্ট মিঠা পানির জলাশয় ও উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী একটি জলচর পাখি। পৃথিবীতে ৬৫ প্রজাতির বক রয়েছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশে ১৮ প্রজাতির বক পাওয়া যায়। যার মধ্যে ৫ টি বগা ( ছোট বগা, মাঝলা বগা, প্রশান্ত শৈল বগা, বড় বগা ও গো বগা) ৯ টি বক ( ধুপনি বক, দৈত্য বক, ধলপেট বক, লালচে বক, চীনাকানি বক, দেশি কানি বক, কালোমাথা নিশি বক, মালয়ি নিশি বক, ক্ষুদে নিশি বক) এবং ৪ টি বগলা ( খয়রা বগলা, হলদে বগলা, কালা বগলা, বাঘা বগলা)।
সারা পৃথিবীতে এদের বিচরণ থাকলেও নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলে এদের বেশি পাওয়া যায়। বক সাধারণত মাছ, ঝিনুক, কাঁকড়া, জলজ পোকা ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে থাকে। খাল, বিল, পুকুর, হ্রদ, ঝিল, হাওড়- বাওড়, নদী, সমুদ্র উপকূল ইত্যাদি অঞ্চলেই এদের বসবাস। এছাড়া, বাঁশঝাড়, বাথান গড়েও এদের দলবদ্ধভাবে বাস করতে দেখা যায়। বর্ষার শুরুতে এরা একবারই প্রজনন করে। এরা একসাথে ২ থেকে ৫ টি ডিম দেয়। অবশ্য বগলা ডিমের সংখ্যা আরও বেশি। ডিম দেওয়ার সপ্তাহের ভেতর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয় এবং সপ্তাহের ভেতর এরা উড়তে শেখে।
কিন্তু বর্তমানে আমাদের অতিপরিচিত নান্দনিক এই বক বিপন্নের পথে। মানুষ মাছখেকো পাখি বেশি খায় বলে দিন দিন বকের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ফাঁদ পেতে অবৈধভাবে বক শিকার, জমিতে কীটনাশক প্রয়োগ, নদী নালা, খাল-বিল ভরাট করে শহরায়ন, বৃক্ষ নিধন প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে বকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। ” বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন” এর ১৯৭৪ এর ২৬ ধারা মতে, অবৈধভাবে পাখি শিকারের জন্য ২ বছরের সাজার বিধান রয়েছে। কিন্তু, আইন থাকা সত্ত্বেও শুধু উখিয়া নয়; চলনবিল, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, সিংড়া, তাড়াস উপজেলা এবং সিলেট জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে বক নিধন করা হচ্ছে। কিছুদিন আগেই খবরের কাগজের একটি রিপোর্টে চোখ আটকে যায়, খবরটা ছিল অনেকটা এইরকম, কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন উপকূলে ফাঁদ পেতে নিধন করা হচ্ছে অসংখ্য সাদা বক। উপজেলার বিভিন্ন বিলের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন অন্তত ২০০ থেকে ২৫০ টির মতো ফাঁদ পাতা হয়। আর এইসব পাতা ফাঁদে প্রতিদিন প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ টি বক ধরা পড়ছে। বক ছাড়াও আরও বিভিন্ন পাখি ধরা পড়ছে এই ফাঁদগুলোতে। বক ধরার জন্য সবুজ ঘাস, প্যারাবন, জলাশয়, ধানক্ষেতের বিভিন্ন স্থানে ফাঁদগুলো পেতে রাখা হয়। এছাড়াও কিছু পোষা বকের মাধ্যমেও বকগুলোকে ফাঁদে এনে ফেলা হয়। বকগুলো গড়ে ৫০-৮০ টাকায় বিক্রি করা হয় স্থানীয় বাজারে। উখিয়া উপজেলার কিছু কিছু পরিবার শুধু এই বক নিধন করেই তাদের পরিবারে অন্নসংস্থান করে।
এই ধরনের ঘটনা যে শুধু উখিয়াতেই ঘটছে তাতো নয়, আমাদের জানা শোনার বাইরেও প্রতিদিন ঘটে চলেছে এই ধরনের নির্মম হত্যাকাণ্ড। বন্যপ্রাণী শিকার ও বিক্রয় আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় বর্তমানে বাংলাদেশে নির্বিচারে পাখি শিকার ও অবাধ বিক্রয় চলছে। এজন্য এই আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের জন্য সরকার এবং জনগন উভয়কেই একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন কঠোরভাবে প্রণয়নের সাথে সাথে বকের জন্য অনুকূল আবাসস্থল বজায় রাখার দায়িত্বও আমাদের সকলের। প্রকৃতির সম্পদ এই পাখিদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থে; আমাদের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও সৌন্দর্য রক্ষার্থে। অন্যথায়, অনেক চেনা জানা পাখির মতো বকও একসময় আমাদের সুন্দর বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে।
এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক