বিশ্ব পরিযায়ী মৎস্য দিবস আজঃ "মাছের সাথে সংযোগ- নদী ও মানুষের"

শাওন চৌধুরী 

আজ, ২৪শে মে, বিশ্ব পরিযায়ী মৎস্য দিবস।এ বছরের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, “মাছের সাথে সংযোগ- নদী ও মানুষের” পরিযায়ী প্রাণি বলতে এমন সব প্রাণি বোঝায় যারা কিনা বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যায় এবং নির্দিষ্ট সময় পরে আবার আগের স্থানে ফিরে আসে। সাধারণত খাদ্যের স্বল্পতা, স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ, প্রজননের সুবিধা ইত্যাদি কারণে এরকম পরিযায় ঘটে থাকে। এটি সব ধরণের প্রাণির মধ্যেই দেখা যায় তবে পাখি ও মাছের ক্ষেত্রে সব থেকে বেশী লক্ষণীয়।

পরিযায়ী পাখি সম্পর্কে সবার স্বচ্ছ ধারণা থাকলেও পরিযায়ী মাছ সম্পর্কে অনেকেরই পরিমিত ধারণা নেই যার কারণে খুব কম সংখ্যক লোকই এ নিয়ে কথা বলেন। তবে এদের বেশিরভাগই পরিযায়ী মাছ হিসেবে স্যামনকেই চেনেন। এরা প্রজননের সুবিধার্থেই এক স্থান হতে আরেক স্থানে যায়। এরকম ঘটনার সাথে সম্পর্কিত দুটি শব্দ আছে, এগুলো হচ্ছে Anadromous ও Catadromous. যেসব মাছ ডিম ছাড়ার জন্য সাগর হতে নদীতে আসে তাদেরকে Anadromous এবং যারা ডিম ছাড়ার জন্য নদী থেকে সাগরে যায় তাদের Catadromous বলা হয়ে থাকে।

ইলিশ হচ্ছে অ্যানাড্রোমাস মাছ আর ইলেকট্রিক ইল হচ্ছে ক্যাটাড্রোমাস মাছ।  শুধুমাত্র ডিম ছাড়ার জন্য একপ্রকার মাছ প্রায় ৩৫০০ মাইল পথ পাড়ি দেয়। এরা হচ্ছে Chinook Salmon. আবার এমন কিছু মাছ আছে যারা কিনা খুবই অল্প দূরত্বের পথ পাড়ি দেয়, এরা এদের গ্রুপ থেকে কিছু দূরেই ডিম পাড়ে যেমন, River Herring তাদের স্কুল থেকে কিছু দূরেই পরিযায়ের জন্য যায়। এদের গ্রুপ স্কুল নামে পরিচিত।Capture

পরিযায়ের সময় অনেক মাছই হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয় এবং নির্দিষ্ট সময় পরে আবার তাদের পূর্ববর্তী বাসস্থানে ফিরে আসে। কিন্তু কিভাবে যে এমনটা সম্ভব তার যথাযথ কারণ এখনও বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করতে পারেননি। মাছের স্মৃতিশক্তি তেমন একটা উন্নত নয় এবং কিছুদিন পরেই এরা আর আগের কথা মনে রাখতে পারেনা এজন্য কিভাবে যে এরা আগের স্থানে ফিরে আসে তা বিজ্ঞানীদের কাছে রহস্যময়। তবে বিজ্ঞানীরা এর পেছনে নানান কারণ দাঁড় করিয়েছেন। তাঁদের কারো কারো মতে, চৌম্বকক্ষেত্র এর সাথে সম্পর্কিত আবার কেও কেও মনে করেন এদের মনে হালকা কিছু স্মৃতি অবশিষ্ট থাকে যার সাহায্যেই এরা আগের স্থানে ফিরে যায়।

সবথেকে মজার বিষয় হচ্ছে, এসব পরিযায়ী মাছ বাস্তুতন্ত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এরা অনেক ছোট থাকা অবস্থায় অন্য স্থানে যেমন সমুদ্রে চলে যায় এবং আবার বড় হয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসে এবং কিছুদিন পরেই বেশিরভাগ সদস্য মারা যায়। এবং এদের শরীর নস্ট হয়ে যায় এবং অন্যান্য প্রাণিদের জন্য নানান ধরণের পুষ্টির উপাদান তৈরী করে। এভাবে এরা বাস্তুতন্ত্রে অনেক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

Chinook salmon হচ্ছে আকারে সবথেকে বড় পরিযায়ী মাছ যাদের কোন কোন সদস্য কিনা ১২৬ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে যদিও এদের বেশিরভাগ সদস্যই ৩০ পাউন্ডের বেশী হয়না।

পরিযায়ের সময়ে মাছগুলো নানান সমস্যার সম্মুখীন হয়। এদের গতি অভিমুখে যদি বাঁধ থাকে তাহলে মাছের সংখ্যা অনেক কমে যায় কারণ প্রতিকূল পরিবেশে এরা ঠিকমতন টিকে থাকতে পারেনা। যেমন এরা কোন স্থানে গেল, যখন ফেরার কথা তখন যদি আগের স্থানের মাঝে কোথাও বাঁধ দিয়ে দেয়া হয় তাহলে এরা আর সেই স্থানে ফেরত আসতে পারেনা এবং ফলশ্রুতিতে মারা যায়। যদিও এসব মাছের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ার পেছনে এসব বাঁধই একমাত্র কারণ নয় বরং নানান ধরণের কাল্ভারটও দায়ী।

কিছু কিছু স্যামন মাছ প্রায় ৬.৫ ফুট পর্যন্ত লাফ দিতে পারে, এমন সুবিধার কারণে এরা নানান সমস্যার হাত থেকে পরিত্রাণ পায়। যেমন ডিম ছাড়ার জন্য উপযুক্ত স্থানে যেতে এদের তেমন একটা বেগ পেতে হয়না আবার সামনে কোন বাঁধা থাকলে এরা সহজেই সেটা অতিক্রম করতে পারে।

Steelhead ও Rainbow Trouts একই প্রজাতির মাছ, প্রথমটি হচ্ছে পরিযায়ী প্রকৃতির আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মিঠাপানির মাছ। বেশিরভাগ পরিযায়ী মাছই একবার পরিযায়ের পর মারা গেলেও Steelhead এমন একপ্রকার মাছ যারা কিনা তাদের জীবনে একাধিক পরিযায়ে অংশ নিয়ে থাকে।

এসব পরিযায়ী মাছের সংখ্যা দিনদিন উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ক্যালিফোর্নিয়ার কলাম্বিয়া রিভার বেসিনে যেখানে ১০ থেকে ১৬ মিলিয়ন মাছ পাওয়া যেত আজ সেখানে মাত্র ১.৫ মিলিয়ন মাছ পাওয়া যায় আবার এদের মধ্যে মাত্র ৪০০০০০ মাছ মুক্তভাবে আসে বাকিগুলো বিভিন্ন হ্যাচারীতে পালন করা হয়।

বাংলাদেশে পরিযায়ী মাছ বলতে প্রধানত ইলিশ কেই ধরে নেয়া হয়, যদিও অন্যান্য আরও অনেক প্রজাতির মাছ বছরের বিশেষ সময়ে পরিযায়ী হয়ে থাকে। জলবায়ু পরিবর্তন, ব্যাপকহারে নদী তথা জলদূষণ এর ফলে আমাদের পরিযায়ী মাছ গুলোর জীবনযাত্রা হুমকির মুখে পড়ছে, সাথেসাথে হুমকির মুখে পড়ছে আমাদের বিশাল দারিদ্র পীড়িত জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা।নদীমহাল গুলো ভরাট আর দখলের কবলে পরে হারাচ্ছে তাঁদের উর্বরতা, সাগরেও বাড়ছে অম্ল।সামুদ্রিক পরিবেশ থেকে নদী মোহনায় পাড়ি দেয়া মাছেরা ডিম পাড়ার জন্য একটি নিরাপদ উৎস খুঁজে খুঁজে শেষে জেলের জালে অকাতরে জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। খাদ্য চাহিদার জন্য আমরা মাছের উপর নির্ভরশীল,সুতরাং খাদ্য চাহিদা বা পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করতে হলেও আমাদের এই মৎস্য সম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসা উচিৎ। সরাকারি বেসরকারি উদ্যোগে খুব কম পরিমাণ ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব হলেও না যথেষ্ট নয়। এর জন্য প্রয়োজন নাগরিক সমাজের সম্মেলিত ও সমন্বিত অংশগ্রহণ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics