
বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস ২০১৪: জীববৈচিত্র্য ও বাংলাদেশ
রাহুল দাশ তালুকদার
জীববৈচিত্র্য মানে প্রাণের বৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্য বলতে সাধারণত উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা, প্রজাতিভেদ এবং বৈসাদৃশ্যকে বুঝানো হয়ে থাকে। তবে ব্যাপক অর্থে পৃথিবীতে জীবনের উপস্থিতি অর্থাৎ Life on earth-ই জীববৈচিত্র্য। এক প্রাণগোষ্ঠী জীবনের তাগিদে অন্য কোন প্রাণগোষ্টীর উপর নির্ভরশীল। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র ও ঔষধ এই প্রধান তিনটি প্রয়োজনীয় উপাদান জীববৈচিত্র্য থেকে প্রাপ্ত। মানুষের জীবনে যত উপকরণও উপাদান প্রয়োজন, তা’সবই পৃথিবীর জীববৈচিত্রের মধ্যে নিহিত রয়েছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বনায়ন বিলোপ,অবিবেচনাপ্রসূত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আর আজ পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য হুমকীর সম্মুখীন। তাই বিশ্ব জীববৈচিত্র্য সংরক্ষন ও গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদের ৬৮ তম অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দিনটি বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে। কারণ, বিশ্ব জীববৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোর মধ্যে পৃথিবীর ৫৬০ তম ও বাংলাদেশের প্রথম রামসার সাইট সুন্দরবন, বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট হাকালুকি হাওড়, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, লাউয়াছড়া উদ্যান, শালবন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের সম্মুখীন। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে দিনের পর দিন কমে যাচ্ছে বনাঞ্চল। প্রাকৃতিক বন উজাড় হওয়ার ফলে হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বন্য প্রানী-পাখি, কীট-পতঙ্গ। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে জীববৈচিত্র্য। পরিবেশের ভারসাম্যতা রক্ষার জন্য একটি দেশের তার মোট আয়তনের ন্যূনতম ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন হলেও ন্যূনতম চাহিদা পূরণে আজ ব্যর্থ আমরা। সর্বশেষ প্রনীত বন্যপ্রাণী (সংরক্ষন ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ এর চারটি তফসিলে বাংলাদেশে উভচর ৩২ প্রজাতির, সরীসৃপ ১৩১ প্রজাতির, ৬২২ প্রকারের পাখি, ৮৩ ধরনের কীট-পতঙ্গ, ১৩৭ ধরনের স্তন্যপায়ী প্রানীসহ বিভিন্ন ধরনের ১২৩১ প্রজাতির উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু ক্রমাগত বনাঞ্চল দখল করে বসতিসহ নানা স্থাপনা তৈরি, উৎপাদন বৃদ্ধিতে কীটনাশক ও আগাছা নাশকের বহুল ব্যবহার,পার্বত্য অঞ্চলে অপরিকল্পিত জুমচাষ, প্রাকৃতিক উদ্ভিদ ও প্রাণীর মাত্রাতিরিক্ত আহরণ, গাছ পাচার সহ নানা কারণে আজ বিভিন্ন প্রজাতি বিলুপ্তির সম্মুখীন। এভাবে চলতে থাকলে খুব অল্পসময়ে জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চল বলতে আর কিছুই থাকবেনা।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে ঘনঘন নিম্নচাপ, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, টর্ণেডো, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি, ভূমিক্ষয়, লবণাক্ততা, ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী-নালা-খাল-বিল ও জলাশয়, নিচে নেমে যাচ্ছে ভূ-গর্ভস্থ পানিস্থর, বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধির ফলে পরিবেশের স্বাভাবিক খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙ্গে পড়ছে এবং মানুষের আচরণগত অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে দেখা দিচ্ছে শারীরিক ও মানসিক জটিলতা। আর ওই বৈশ্বিক উষ্ণতারবৃদ্ধির প্রভাবক হলো প্রাকৃতিক কারণ ও মনুষ্যজনিত উষ্ণতাবৃদ্ধি কারক গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধি। বৈশ্বিক উষ্ণতাবৃদ্ধি জনিত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও বিপর্যয়রোধে দীর্ঘমেয়াদী কার্যকর পদপে গ্রহণ না করলে কক্সবাজারসহ উপকুলীয় নিম্নাঞ্চল সমূহকে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হওয়া থেকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনে জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি উন্নয়নের নামে দিন দিন জীববৈচিত্র্যের আবাসস্থল ধংস হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবনসহ বিভিন্ন জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলের পরিবেশ ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। জীববৈচিত্র্যের আধার এইসব বনাঞ্চল সুরক্ষায় রাখতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার একান্ত প্রয়োজন। সুন্দরবন রক্ষা করতে না পারলে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল অরক্ষিত হয়ে পড়বে। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষনে দরকার সম্মলিত উদ্যোগ। বিশ্ব জীববৈচিত্র্য দিবসকে সামনে রেখে তাই আজ আমরা সমগ্র বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এক হয়ে কাজ করার শপথ নেই। যদি প্রাণী বাঁচে আমরা বাঁচবো, আমরা বাঁচলে বাঁচবে প্রাণীকুল। আসুন, সকলে মিলে তাই বাঁচি সবুজ পৃথিবীতে, সবুজের কোলে।
লেখকঃ সভাপতি- প্রাধিকার, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়