বুড়িগঙ্গা তার যৌবন হারাতে বসেছে
গোলাম মোস্তবা
পৃথিবীতে যত রকম সভ্যতা গড়ে উঠেছে এবং উঠবে সব সভ্যতার পিছনে নদীর ভূমিকা অনস্বীকারর্য্য। ১৬১০ সালে রাজধানী ঢাকার রূপকার ইসলাম খান বুড়িগঙ্গা দিয়ে ঢাকায় এসে পৌঁছেন। মোগলদের যুগেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল বুড়িগঙ্গা। এ নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এ বাংলার জীবিকা, চলাচল, পরিবহন, কৃষ্টি, শিল্প, সভ্যতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন। এই বুড়িগঙ্গা দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মসলিন, নীল, আর পাট।
বুড়িগঙ্গা ছিল এক সময় বিশাল, গভীর আর প্রশস্ত এক নদী। এ নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে রূপালি ইলিশ আসত, পালতোলা নৌকা চলতো নিজ গন্তব্যের উদ্দেশে, ছিল প্রাণের স্পন্দন। এ নদী দিয়েই সওদাগার, পরিব্রাজক ও ব্যবসায়ীরা বিশাল বিশাল বাণিজ্য জাহাজে চড়ে ব্যবসা বাণিজ্য করতে আসতো। এভাবে ঢাকা হয়ে ওঠে প্রাচ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। ফলে কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে বুড়িগঙ্গার বুক।
রাজধানীর কোল ঘেঁষে যে নদী একটা মহানগরকে এত কিছু দিল, এত বছর ধরে বুকে আগলে রাখছে সেই বুড়িগঙ্গা এখন আর খরস্রোতা নেই। এখানে নেই স্বচ্ছ পানির প্রবাহ, মৎস্য সম্পদ কিংবা জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। রীতিমতো বিষাক্ত বর্জ্যের বহমান আধারে পরিণত হয়েছে বুড়িগঙ্গা। প্রতিদিন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গৃহস্থালি, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা ও নৌযানের বিপুল পরিমাণ কঠিন ও তরল বর্জ্য নিক্ষেপ এবং সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় ভূমিদস্যুদের অবৈধ আগ্রাসনে বুড়িগঙ্গা তার যৌবন হারিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি ব্যবহার করা তো দূরের কথা নদী পার হওয়ার সময় অন্তরে যদি সাধ জাগে এক আঁচল পানি হাতে তুলে নেবেন সেই আশাও দূরাশা।
প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার ঘনমিটারের বেশি শিল্পবর্জ্যসহ কাঁচাবাজার, গৃহস্থালি ও হাসপাতালের বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় প্রায় ১০ হাজার গার্মেন্ট, ডায়িং, ওয়াশিং, প্লাস্টিক, পলিথিন, চামড়ার কারখানা রয়েছে। অধিকাংশ কারখানাগুলো থেকে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল বর্জ্য কোনো রকম পরিশোধন ছাড়াই বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। এছাড়া বুড়িগঙ্গা নদীর চারপাশে অর্ধশত সুয়ারেজ পাইপ রয়েছে যেগুলো থেকে ২৪ ঘণ্টা বিষাক্ত পানি নদীতে পড়ছে। একইভাবে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জ থেকে ২৫-৩০টি খালের মধ্য দিয়ে বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। এসব বিষাক্ত দ্রব্য অপরিশোধিত আকারে নদীতে ফেলায় পানি শুধু দূষিতই নয়, বিবর্ণও হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানিতে বিষাক্ত ক্ষার ও সিসার কারণে জাহাজের তলদেশ ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। নৌযানের বিভিন্ন যন্ত্র ও যন্ত্রাংশে এই পানি লাগলে মুহূর্তে তাতে মরিচা পড়ে যায়।
বছরের যে সময়টিতে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি ভালো থাকার কথা সে সময় HQ40d Multiparameter Meter দিয়ে বুড়িগঙ্গার পানি পরীক্ষা করে দেখা যায় বুড়িগঙ্গা ভয়াবহ দূষণের শিকার। সাধারণত প্রতি লিটার পানিতে ডিও (Dissolved Oxygen) থাকার কথা ৬ মিলিগ্রাম। যদি এর নিচে নেমে যায় তবে প্রাণীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। সদরঘাট টার্মিনালের পূর্ব প্রান্ত, ধোলাইখাল, বুড়িগঙ্গার ১ম ব্রীজ, শ্যামপুর খাল, শ্যামপুর খালের ভাটি, পাগলা, পাগলা শোধনাগার এর পাইপ, শুবাড্ডা খাল, বাতামতলী ঘাট, মিডফোর্ড হাসপাতাল, চাঁদনী ঘাট, কামরাঙ্গীর চর, সিকদার মেডিক্যাল, বছিলা, আমিনবাজার এবং গাবতলী এলাকার পানি পরীক্ষা করে দেখা যায় এসব এলাকার প্রতি লিটার পানিতে ডিও যথাক্রমে ০.২৪, ০.৭৯, ১.১০, ১.৬৬, ০.৯৮, ০.৬৩, ০.৫৬, ২.১৯, ১.১০, ০.২৯, ০.৬০, ০.৫১ যার ফলে মাছের মত জলজ প্রাণীগুলি নদীতে টিকে থাকতে পারছে না। পাগলা থেকে গাবতলী পর্যন্ত পরিদর্শন কালে একজন জেলেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এতেই প্রমাণিত হয় বুড়িগঙ্গার পানি কতটুকু দূষণের শিকার।
২০১১ সালের ১ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছিল, বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এ পানিকে আর পানি বলা যাবে না। ওই সময় বুড়িগঙ্গা নদীর সঙ্গে সমস্ত সংযুক্ত পয়ঃপ্রণালি এবং শিল্প কারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন লাইন বন্ধ করতে ওয়াসার চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু নির্দেশ ওই পর্যন্তই। প্রতিরোধ তো দূরের কথা নদী দূষণ দিন দিন আরো ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
বুড়িগঙ্গার এই অবস্থা কিন্তু কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরূপ প্রভাবের কারণে নয়। মানুষই এর জন্য একমাত্র দায়ী। আমাদের এই জনপাপ কি প্রকৃতি আমাদের ফেরত দিবে না ? বুড়িগঙ্গার এই হত্যা দশা একদিন কি মহানগরী ঢাকার জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দেবে না? আমাদের এই মৌনতা, নমনীয়তা, অনৈক্যতা, গতিশীল প্রতিবাদ না করার ফলে আমরা হারাবো বুড়িগঙ্গা। হয়তো মৃত সরীসৃপের মতো পড়ে থাকবে খরস্রোতা রাজধানীর এই হৃৎপিন্ড। ‘বুড়িগঙ্গা বাঁচাও’ বলে হৃদয়বিদারক আর্তনাদ করেও হয়তো আর লাভ হবে না। কাজেই আমাদের প্রয়োজনে এই বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে আমাদের আরো বেশি সচেতন, দরদি এবং সজাগ হওয়া উচিত।
উর্ধ্বতন কর্মকর্তা
বাংলাদেশ রেলওয়ে