মহাবিপন্ন পালাসি কুরাঈগল
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
বাইক্কা বিল জুড়ে তখন দুপুরের রোদের উজ্জ্বলতা। জলজ উদ্ভিদের গা ঘেঁষে ধীরে এগিয়ে চলেছে আমাদের নৌকাটি। এমনই সময় হঠাৎ একটি পালাসি কুরাঈগলের দেখা মিলল। উঁচু জলাভূমির একটি অংশে গাম্ভীর্যময় ভঙ্গিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সজাগ দৃষ্টিতে পাখিটি আমাদের নৌকা লক্ষ্য করছিল। আমরা সীমারেখার মধ্যে চলে আসতেই হঠাৎ উড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল সে। বিশাল ডানায় শব্দ তুলে বড় আকারের এই শিকারি পাখিটি নিজেকে দ্রুতই সরিয়ে নিল নিরাপদ দূরত্বে। খাদ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে ঈগলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। উড়ন্ত অবস্থায় দৃশ্যমান শিকারের ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে একসময় ‘ছোঁ মেরে’ শিকারটি ধরে উড়াল দেয়। এ কাজে ওরা যথেষ্টই পটু। এ জন্য ওদেরকে সুতীক্ষ্ম নখের অব্যর্থ শিকারিও বলা হয়। উঁচু স্থানে বসে চারদিকে নজর রাখে। খাদ্যের সন্ধানে ডানায় ভর করে শূন্যে নিঃশব্দে চক্রাকারে টহল দিতে থাকে। পছন্দমতো শিকার চোখে পড়লে মুহূর্তে লক্ষ্য স্থির রেখে বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে সেটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কী ঘটল – তা বুঝে ওঠার আগেই জীবন্ত শিকারটি মৃত্যুথাবায় আটকা পড়ে যায়। এ পাখিটির ইংরেজি নাম Pallas’s Fish Eagle, বৈজ্ঞানিক নাম Haliaeetus leucoryphus.
পাখিগবেষক ও আলোকচিত্রী সায়েম ইউ পচৗধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, “বর্তমান সময়ে পালাসি কুরাঈগল আমাদের দেশে ‘মহাবিপন্ন’ এবং বিশ্বে ‘সংকটাপন্ন’ প্রাণী হিসেবে বিবেচিত। পাখিটি এখন কেবল সিলেটের বিভিন্ন হাওর-জলাশয় এবং সুন্দরবনের মিঠাপানি এলাকায় দেখা যায়। এরা শীত মৌসুমে আমাদের দেশে আসে। বাচ্চা উৎপাদন করে বর্ষা মৌসুমে উত্তর মেরুর দিকে চলে যায়। ভারত, নেপাল, ভুটান, চীন, সাইবেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।”
গবেষক সায়েম বলেন, ‘আগে দেশের সবখানেই কুরাঈগল দেখা যেত। এরা সুউচ্চ হিজল-করচ গাছে বাসা করে থাকে। এসব গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলায় ওদের প্রজননও অনেক কমে গেছে। তাছাড়া এদের বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক নির্জন জলাভূমি প্রয়োজন। আমরা যেভাবে প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলো ধ্বংস করে ফেলছি তাতে করে ওদের চরম খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। আবাসস্থল ধ্বংস ও খাদ্য সংকটে ওদের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। বাইক্কা বিল ও টাঙ্গুয়ার হাওরে কুরাঈগলের বসবাস ও ছানা উৎপাদনের উপযোগী করে টাওয়ার নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এগুলো এখন পর্যন্ত ওরা ব্যবহার করেনি।’
তিনি আরো বলেন, ‘পূর্ণবয়স্ক একটি কুরাঈগল দৈর্ঘ্যে ৮০ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। ছেলেপাখিটি মেয়ে পাখির চেয়ে আকারে কিছুটা বড়। চোখ হলুদ এবং ঠোঁট কালচে। পিঠের দিক কালচে বাদামি এবং দেহের নিচের অংশ লালচে-বাদামি। মাথা, ঘাড় ও কাঁধ-ঢাকনি ফিকে সোনালি-পীতাভ। ডানার নিচের দিক কালো এবং কালো লেজে ফিতার মতো অর্ধচন্দ্রাকার সাদা অংশ রয়েছে। সাধারণত জোড়া বেঁধে থাকে। উঁচু গাছে বসে থেকে বা মাটিতে নেমে অথবা বাতাসে উড়ে উড়ে এরা শিকার খুঁজে বেড়ায়। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে মাছ, জলচর পাখি, সাপ, ব্যাঙ, কচ্ছপ ইত্যাদি। অক্টোবর-ফেব্র“য়ারি এদের প্রজনন মৌসুম। জলাশয়ের ধারে উঁচু গাছে ডালপাতা ও ঘাস দিয়ে বাসা করে। মেয়েপাখি দুই থেকে চারটি ডিম পাড়ে। ডিমগুলোর রঙ সাদা। ছানার জন্য মা-বাবা উভয়ই খাদ্য সংগ্রহ করে আনে। আর মেয়েপাখিটি সেই খাদ্য ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরো করে ছানার মুখে তুলে দেয়।’
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন : প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক এবং
দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
biswajit.bapan@gmail.com
সূত্র : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠের শেষের পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদন।