
রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট ; সবুজ যেথায় নিরুপদ্রুত…
লিসান আসিব খান
“নদী হয়ে থাকলে হয়তো
বয়ে যাওয়া যেতো নির্দ্বিধায়
তবুও
কখনো কখনো সব ভয় ভুলে
জলপ্রপাতের ধারার মতো
পাথরের বুকে ঝাঁপ দিয়ে কাঁদতে
বড় ইচ্ছা হয়”
আপনার শহুরে মন অশান্ত, কাজের চাপে, কিংবা পড়াশোনার টেনশনে আপনি ক্লান্ত, বিরক্ত এবং অশান্ত। তাহলে আপনাকে একটা ভালো খবর দেই। আপনার মনকে প্রশমিত করতে এটি কাজে লাগতে পারে , এটি হল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্ট ।সিলেট বিভাগের অন্তর্গত মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা। এর কাছাকাছি অবস্থিত কমলগঞ্জ উপজেলা। দেখা ও ঘুরার মত অনেক জায়গা আছে , তার মধ্যে এটি হল একটি রোমাঞ্চকর জায়গা। সংরক্ষিত বন বলতে যা বোঝায় তার সব উপসর্গ নিয়েই রাজকান্দি সংরক্ষিত বন দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সিমানা জুড়ে , ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে। অক্ষাংশ ৯১.৯১ এবং ২৪.২৫ দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এ বন প্রধানত বাঁশ মহাল হিসেবে বিখ্যাত। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এ বনে বাঁশ আহরণ কমে যায় এছাড়াও, সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত বলে ভারতীয় বিচ্ছিনতাবাদি গেরিলাদের উৎপাতে এ বনে বাঁশ সংগ্রহ কমে যেতে থাকে। ফলস্বরূপ, এর ঘনত্ব ও গভীরতা দুটোই বৃদ্ধি পায়। শ্রীমঙ্গল এবং সন্নিহিত এলাকায় সাধারণত বৃষ্টি অরণ্য নামে পরিচিত । যদিও এখন সবচেয়ে জনবহুল দেশে বন এবং বন্যজীবন উভয়ই টিকে থাকার লড়াই করছে ।
পাহাড়বেষ্টিত দুর্গম এই বনে রয়েছে ৫০ বছর ধরে বেড়ে ওঠা মূল্যবান গাছগাছালি । সিলেট বন বিভাগের আওতাধীন কমলগঞ্জের রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের অধীনে একটি বিট হচ্ছে কুরমা। এই কুরমা বিটে রয়েছে হাজার হাজার সেগুন, চাপালিশসহ নানা প্রজাতির গাছ। বাঁশ ছাড়াও এ বনে পাতা ঝরা বৃক্ষ, কলা, পাহাড়ি অর্কিড ছাড়াও অন্যান্য গুল্ম ও বৃক্ষ জাতীয় গাছ দেখতে পাওয়া যায়।
রাজকান্দি বনাঞ্চলে রয়েছে সারি সারি কলাগাছ, জারুল, চিকরাশি কদম গাছ। এর ফাঁকে ফাঁকে উড়তে থাকে রং-বেরঙের প্রজাপতি। ডুমুর গাছের শাখা আর বেত বাগানে দেখা মিলবে অসংখ্য চশমাপরা হনুমানের। এছাড়াও রয়েছে ডলু, মুলি, মির্তিঙ্গা, কালি ইত্যাদি বিচিত্র নামের বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ।
রাজকান্দির এদিক সেদিক এবং ঝরনার কাছাকাছি মানুষের বাঁশ কাটার কিছু দৃশ্য লক্ষ করা যাবে । রাজকান্দির ঝরনার পরিষ্কার জলের নীচে অনেক সুন্দর পাথরের সন্ধান পাওয়া যায় , সময়ে অসময়ে যারা খুব পিচ্ছিল হয়ে উঠে । পুরো পথ প্রাকৃতিক দৃশ্যে পরিপূর্ণ , দেখা মাত্র যে কারো মন আনন্দে ভরে উঠবে।বনের শুরুর জায়গা থেকে কিছু ছোট ছোটো পাহাড় চোখে পড়বে। বন কাছাকাছি রয়েছে চমৎকার কিছু চা বাগান। শুধুমাত্র ৩ জন বন রক্ষী রাজকান্দির এই ৪,০০০ বর্গ কিমি এর মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ দেখা শোনার জন্য রয়েছে। খুরমা , খাসিয়া পল্লি এবং বিভিন্ন গ্রাম এর মানুষজন সাধারণত চার থেকে পাঁচ ঘন্টা হেঁটে প্রতিদিন বনের ভিতরে প্রবেশ করে এবং বাঁশ ,কলা সহ প্রয়োজনীয় জ্বালানী সংগ্রহ করে থাকে।
“হামহাম” জলপ্রপাত
প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টির অন্যতম একটি হলো বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জে অবস্থিত ‘হাম-হাম’ জলপ্রপাত। লোকচক্ষুর অন্তরালে দীর্ঘদিন নিজের মহিমা লুকিয়ে রেখেছিল এই জলপ্রপাত। দূর্গম পথ আর লোকালয়ের বেশ বাইরে থাকার কারণে এতোদিন এই জলপ্রপাতটি কারও চোখে পড়েনি। জলপ্রপাতটি ২০১০ আবিষ্কার করা হয়। পুরো পথটি অনেক উত্তেজনাপূর্ণ । দুর্গম গভীর জঙ্গলে এই ঝরণাটি ১৬০ ফুট উঁচু । বর্তমানে এই জলপ্রপাতটি দেখতে আর রোমাঞ্চকর প্রবেশপথ পাড়ি দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই ভীড় করেন নানা বয়েসের মানুষ।
কখনও কখনও স্নানাগার বা গোসলখানা বলা ‘হামহাম’ জলপ্রপাতকে। বন এবং চা বাগান দ্বারা বেষ্টিত একটি রোমাঞ্চকর জলপ্রপাত। এটি গভীর বনের মধ্যে অবস্থিত এবং তুলনামূলকভাবে অক্ষত রয়েছে. জলপ্রপাতের নিচে গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০ মিটার বিস্তৃত স্বচ্ছ জলাশয় । হাম হামের রয়েছে দুটো ধাপ, প্রথম ধাপটি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে মাঝখানের ধাপে, এবং সেখান থেকে আবার পানি পড়ছে নিচের অগভীর খাদে ।
“ আতেকা” জলপ্রপাত
আতেকা জলপ্রপাত একটি বিস্ময়কর এবং বাংলাদেশের একমাত্র ১০ ধাপ জলপ্রপাত। এই জলপ্রপাত রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের উল্লেখযোগ্য আরেকটি ঝর্না। মজার ব্যাপার হলো, এই ধাপগুলো কখনোই পিচ্ছিল হয় না । যে কেউ সহজেই পাথরের উপর উঠে আরোহণ করতে পারবে ।বর্ষাকালে দ্বিতীয় ধাপে সাঁতার কাটা যায় এবং তারপর পরবর্তী ধাপে অনায়াসে যাওয়া যায় । ঝর্নার আশেপাশে কিছু অজানা ফল পাওয়া যায় কিন্তু সেগুলো না খাওয়াই ভালো। প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি চমৎকার জায়গা । ঝর্না কাছাকাছি অল্প সংখ্যক ত্রিপুরা আদিবাসী বসবাস করে ।
” বন্য ল্যান্টানা “
এই বন্য Lantana বা ল্যান্টানা ফুল রাজকান্দির গভীর অরণ্যে দেখতে পাওয়া যায়। এটি ৬-৮ ফুট উচ্চতার একটি চিরহরিৎ উদ্ভিদ । Lantana উদ্ভিদের পাতা ,ডালপালা এবং কিছু রুক্ষ পাপড়ি আছে যে কেউ আলিঙ্গনে এটি একটি মোটামুটি তীব্র কটু গন্ধ তৈরি করে । ফুলের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে তার রং পরিবর্তন করতে দেখা যায় । তাই একে হলুদ , গোলাপী এবং সাদা রঙে মাঝে মধ্যে খুজে পাওয়া যায় ।