
লাউয়াছড়ায় গবেষণা; সোনালী কচ্ছপের গায়ে ট্রান্সমিটার
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
পৃথিবীব্যাপী মহাবিপন্ন তালিকাভুক্ত উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ বা সোনালি কচ্ছপ। পাহাড়ি অঞ্চলের অধিবাসীরা এবং চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এদের ধরে হত্যা করে খেয়ে থাকে বলে বর্তমানে এরা আমাদের দেশেও ঠাঁই নিয়েছে বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায়। ডাঙ্গায় থাকে বলে এরা সহজেই মানুষের নজরে আসে। আর এভাবেই এদের সংখ্যা আজ অনেকটাই কমে গেছে। এছাড়াও বনভূমি উজাড়সহ প্রাকৃতিক পাহাড়ি পরিবেশ ধ্বংস এদের বিপন্ন হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ। বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মিশ্র চিরসবুজ বনেই বা এর আশপাশেই অল্প সংখ্যায় এদের বসবাস। এদের ইংরেজি নাম Elongated Tortoise এবং বৈজ্ঞানিক নাম Imdptestido elongata। এরা মূলত ডাঙ্গার কচ্ছপ। অন্য যেসব কচ্ছপ আমরা পানিতে দেখি তারা ডাঙ্গায় বেশি সময় থাকে না। কিন্তু এ কচ্ছপটি ডাঙাতেই বেশি সময় থাকে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এবং সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন নেচারাল রিসোর্সেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (ক্যারিনাম) এর উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ কচ্ছপ প্রকল্প’ নামে একটি গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১৩ জুন শুক্রবার বিকেলে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে তিনটি বিপন্ন সোনালি কচ্ছপের শরীরে রেডিও ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়। স্থাপনের পূর্বে ভাল করে তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ পরীক্ষা করা হয়। পরবর্তীতে সেদিনই একটি কচ্ছপকে এবং ১৪ জুন শনিবার দুপুরে অবশিষ্ট কচ্ছপদের লাউছড়ার গভীর বনে অবমুক্ত করে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে সোনালি কচ্ছপ গবেষণা প্রকল্পের শুভ উদ্বোধন ঘোষিত হয়। কিছুদিন পূর্বে বান্দরবানের লামা থেকে একটি পুরুষ ও একটি স্ত্রী এবং লাউয়াছড়ার বাগমারা এলাকার থেকে একটি স্ত্রী প্রজাতিসহ মোট তিনটি সোনালি কচ্ছপ উদ্ধার করে আনা হয়।
অবমুক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিতি ছিলেন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের রেঞ্জ কর্মকর্তা মরতুজ আলী, বন্যপ্রাণী গবেষণা প্রতিষ্ঠান কারিনামের প্রধান নির্বাহী ড. এসএমএ রশিদ, দেশের স্বনামধন্য উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী বিশেষজ্ঞ (হার্পেটোলজিস্ট) এবং কচ্ছপ গবেষণা প্রকল্পের প্রধান গবেষক শাহরীয়ার সিজার রহমান, উভচর প্রাণী গবেষক অনিমেষ ঘোষ অয়ন, গবেষক ফারজানা তাসকিন প্রমুখ। এছাড়াও ৯জন বিদেশি বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আমেরিকার বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী স্কট ট্রেগসার, বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী অ্যাশ উইস্কোভিজ, প্রাণিচিকিৎসা (ভেটেরিনারি) বিভাগের গবেষক এরিন ট্রেগসার, উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী বিশেষজ্ঞ (হার্পেটোলজিস্ট) জনাথন হাকিম, পরিবেশ বিজ্ঞানী ডিন ল্যাম্বারর্স এবং উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী বিশেষজ্ঞ ইভান আরমবল, আস্ট্রেলিয়ার বন্যপ্রাণী গবেষক লকি গিলডিং ও বন্যপ্রাণী গবেষক ম্যাক্স জনসন এবং মেক্সিকো’র উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী বিশেষজ্ঞ রিকার্ডো রামিরেজ।
বাংলাদেশ কচ্ছপ প্রকল্পের প্রধান গবেষক এবং উভচর ও সরীসৃপ প্রাণী বিশেষজ্ঞ শাহরীয়ার সিজার রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সংরক্ষণ এবং গবেষণার উদ্দেশ্যেই মূলত তিনটি সোনালি কচ্ছপে গায়ে তিনটি ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়েছে। তার সম্বলিত গোলাকৃতির একেকটি ট্রান্সমিটারের ওজন মাত্র ১০ গ্রাম। প্রায় দু কেজি ওজনের কচ্ছপের জন্য এটির ওজন অতি অল্পই। বিশেষ ধরণের আঠা দিয়ে কচ্ছপের পিঠের উপর এটি লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনশত মিটার থেকে এক হাজার মিটার দূরত্ব পর্যন্ত এদের গতিবিধির সংকেত পাওয়া যাবে। এর ফলে তাদের বিরচণ ও অবস্থানের বিভিন্ন তথ্য আমরা সংগ্রহ করতে পারবো।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই কচ্ছপের প্রধান সমস্যা হচ্ছে মানুষ তাদের ধরে খেয়ে ফেলে। তাদের বাঁচিয়ে রাখতে তাদের উপর পর্যাপ্ত গবেষণা ও তথ্যের প্রয়োজন।’
বন্যপ্রাণী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ক্যারিনাম’ এর নির্বাহী প্রধান ড. এস এম এ রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বনবিভাগের সাথে যৌথ উদ্যেগে আমরা গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে আমরা ইতিমধ্যে তিন প্রজাতির দেশীয় কচ্ছপের প্রজনন রক্ষায় সফলতার সাথে কাজ করে চলেছি। এখন আমাদের গবেষণায় যুক্ত হলো এই সোনালি কচ্ছপ। আবাস স্থান নষ্ট এবং ব্যাপকভাবে ধরে খেয়ে ফেলার ফলে এ কচ্ছপের সংখ্যা এখন একেবারেই বিলুপ্তির পথে। আইইউসিএন থেকেও একে লাল তালিকাভুক্ত প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’
শাহরীয়ার সিজার রহমান আরো বলেন, ‘সোনালি কচ্ছপের সারা শরীর জুড়ে থাকে হলুদ রঙের মধ্যে কালো কালো ছাপ। প্রজনন মৌসুম ছাড়া এরা ঘন বন, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, ঝোপঝার ও ছড়ার আশেপাশে সাধারণত একাই বিচরণ করে। মে থেকে অক্টোবর প্রজননকালে ২টি থেকে ৯টি পর্যন্ত ডিম পেড়ে সেগুলো মাটিচাপা দিয়ে থাকে। তিন থেকে পাঁচ মাস পর ছানা বের হয়।’
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন
প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ক লেখক,
শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি, দৈনিক কালের কণ্ঠ
এবং
স্পেশালিস্ট এনভায়রনমেন্ট করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটুয়েন্টিফোর.কম
biswajit.bapan@gmail.com
সূত্র : ১৫ জুন ২০১৪ দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদন।