
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেই
বিভিন্ন কারণে উচ্চ শব্দের উৎসসমূহ একদিকে যেমন বাড়ছে একইসাথে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় শব্দ দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে বিরাজ করছে। পবা ঢাকার বিভিন্ন স্থানের শব্দের মাত্রা নিরুপণ ও পর্যবেক্ষণে দেখতে পায় স্থানভেদে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় উল্লেখিত মান মাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে। শব্দ দূষণের কারণে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বেড়ে যায়, অনিদ্রা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, মনসংযোগ কমে যাওয়া, মাথা ব্যাথা ও মাথা ধরা, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তিবোধ এমনকি অস্বাভাবিক আচরণ করার মত মনোদৈহিক নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০০৬ সালে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হলেও এর কোন প্রয়োগ নেই বললেই চলে। শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি লাঘবে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, রাজউক, স্থানীয় সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী। আজ ৩০ এপ্রিল ২০১৪, বুধবার, সকাল ১১ টায় পবা কার্যালয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও ডাব্লিউবিবির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
পবা ঢাকার বিভিন্ন স্থানের শব্দ দূষণমাত্রা জরিপ ও পর্যবেক্ষণ করে আসছে। জরিপকৃত ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়,
- নীরব এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৮৪-১০০ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বেশী।
- আবাসিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৮৪-৯৩ ডেসিবেল যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণেরও বেশী।
- মিশ্রএলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৮৮-১০২ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণেরও বেশী।
- বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৮৬-১০৩ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণ বেশী।
জরিপ হতে প্রাপ্ত ফলাফল মানুষের মানসিক ও শারীরিক সমস্যার জন্য অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এভাবে শব্দ দূষণ চলতে থাকলে শিশুদের মধ্যে বধিরতার হার ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে এবং তারা লেখাপড়ায় অমনোযোগী ও বিকার মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক, কান ও গলা বিভাগ কর্তৃক ২০১৩ সালে পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এক-তৃতীয়াংশ লোক কোন না কোন শ্রুতিক্ষীণতায় ভুগছেন এবং ৯.৬ শতাংশ শ্রুতি প্রতিবন্ধী। একই সাথে দেশে ১৫ বছর বয়সের নিচের জনসংখ্যার মধ্যে শ্রুতি প্রতিবন্ধীর হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ২.৫ শতাংশ বেশী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে বধিরতার হার ক্রমশই বাড়ছে। বিশ্বের ১৫ শতাংশ মানুষ কোন না কোন পর্যায়ের শ্রুতিক্ষীণতায় ভুগছেন। আবার তাদের অধিকাংশই শিশু, যারা আগামী দিনে জাতিকে এগিয়ে নেবে। আর বিশ্বের ৫ শতাংশ লোক বধিরতায় ভুগছেন, যা তাদের নিত্যদিনের কার্যক্রম এবং জীবন-জীবিকার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
২০০২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শ্রুতিক্ষীণতার হার ছিল ৭.৯ শতাংশ এবং ভারতে ৬.৩ শতাংশ। সংস্থাটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শ্রুতিক্ষীণতার জন্য ঝুকিপূর্ণ অব্জল হিসাবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৬০ ডেসিবল শব্দে মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট এবং ১০০ ডেসিবল শব্দে চিরতরে শ্রবনশক্তি হারাতে পারে।
পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন ডাব্লিউবিবির সিনিয়র প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর নাজনীন কবীর, পবার কো-অর্ডিনেটর আতিক মোরশেদ, বিসিএইচআরডির নির্বাহী পরিচালক মো: মাহবুল হক, বাংলাদেশ পীস মুভমেন্টের সভাপতি অধ্যাপক কামাল আতাউর রহমান, নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের সহ-সম্পাদক মো: সেলিম, জনউদ্যোগের সহকারী সমন্বয়কারী তারিক হোসেন মিঠুল, এস এ হাসান প্রমুখ।
সভায় উল্লেখ করা হয়- উচ্চ শব্দ শিশু, গর্ভবতী মা এবং হৃদরোগীদের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করছে। আকস্মিক উচ্চ শব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়, মাংসপেশির সংকোচন করে এবং পরিপাকে বিঘœ ঘটায়। এছাড়াও শ্রবণশক্তি কমে আসে, বধির হওয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি হয়, মাথা ব্যথা, বদহজম, অনিদ্রা, মনসংযোগ কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তিবোধ, এমনকি অস্বাভাবিক আচরণ করার মত মনোদৈহিক নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। কন্ঠনালীর প্রদাহ, আলসার, মস্তিকের রোগও হতে পারে। হঠাৎ খুব জোর শব্দ যেমন যানবাহনের তীব্র হর্ণ বা পটকা ফাটার আওয়াজ মানুষের শিরা ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রচন্ড চাপ দেয়। এধরনের শব্দের প্রভাবে সাময়িকভাবে রক্তপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়, রক্তনালী সংকুচিত হয়, রক্তে কোলেষ্টেরলের মাএা বাড়িয়ে দেয়। উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী হর্ণ মোটরযানের চালককে বেপরোয়া ও দ্রুত গতিতে যান চালাতে উৎসাহিত করে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়।
শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালায়, ২০০৬ -এ হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বা একই জাতীয় অন্য কোন প্রতিষ্ঠান এবং এর চারপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা “নীরব এলাকা” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । নীরব এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোন প্রকার হর্ণ বাজানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসমূহ নিজ নিজ এলাকার মধ্যে নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক, বা শিল্প এলাকাসমূহ চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড স্থাপন ও সংরক্ষণ করবে। এই বিধিমালার বিধান লংঘন অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। কোন ব্যক্তি নির্ধারিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তিনি প্রথম অপরাধের জন্য অনধিক ১ মাস কারাদন্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য অনধিক ৬ মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে বা উভয় দন্ডে দন্ডণীয় হবেন।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নিন্মোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানানো হয়-
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, মোটরযান মালিক ও ড্রাইভারদের উচ্চ শব্দসৃষ্টিকারী হর্ন ব্যবহার না করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা, নীরব এলাকায় হর্ণ না বাজানো ও অন্যান্য এলাকায় অপ্রয়োজনে হর্ণ না বাজানোর জন্য মোটরযান ড্রাইভারদের উদ্বুদ্ধ করা, যানবাহন নিয়মিত মেরামত করা, লাউড স্পীকারের ব্যবহারে সচেতন হওয়া, অডিও ক্যাসেটের দোকানে উচ্চ শব্দে গান বাজানো নিয়ন্ত্রণ করা, কলকারখানায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং প্রচলিত আইনের বাস্তবায়ন, উচ্চ শব্দের হর্ণ আমদানী বন্ধ করা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, সিটি কর্পোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নিজ এলাকার মধ্যে নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প বা মিশ্র এলাকা চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড স্থাপন ও সংরক্ষণ করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা চালানো, সর্বোপরি সকলের সরকারী বিধিবিধান মেনে চলা।
এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক