শৈলকুপায় দেশীয় মাছের বংশ ধ্বংস নষ্ট হয়ে গেছে উৎস সংশ্লিষ্টরা নীরব

শৈলকুপা (ঝিনাইদহ) থেকে শিহাব মল্লিক :

এখন ভরা বর্ষা। খাল-বিল পানিতে থৈ-থৈ আর মৎস্যজীবীদের নির্ঘুম রাত জাগার কথা। ভোরের আলো ফুটতেই গ্রামের ছোট ছোট হাট-বাজার আর পাড়া, মহল্লায় জেলেদের হাঁক-ডাকে মুখরিত হওয়ার সুদিন ফুরাতে বসেছে। ‘মাছে ভাতে বাঙালী’ অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে প্রাকৃতিক মাছ শূন্য শহর থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানব দেহে প্রাণীজ আমিষের ৭৮ ভাগ পূরণে সক্ষম নানা প্রজাতির ছোট মাছের অভাবে জনজীবনে পুষ্টিহীনতার প্রকোপ বাড়ছে বৈ কমছে না। বিল-বাওড় ও নদ-নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়া, নদীর নাব্য হ্রাস, খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, মা মাছ নিধন, জলাশয় দূষণ, পানিতে কীটনাশক প্রয়োগ, রাক্ষুসে মাছের চাষ, মৎস্য আইন অমান্য ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছোট মাছ বিলুপ্তির হওয়ার অন্যতম কারণ বলে মৎস্য অফিস সূত্র জানা যায়। শৈলকুপায় আকাশ  ছোঁয়া মাছ বাজারে নি¤œবৃত্ত ও মধ্যবৃত্তের নদীর মিঠাপানির সুস্বাদু ছোট মাছ ক্রয়ক্ষমতা সাধ্যের একেবারে বাইরে প্রায়। সাধ ও সাধ্যের মিলন মেলায় ছোট মাছের বাজারে অভাবী মানুষেরা শুধু বিত্তশালীর দাম হাঁকা দেখেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। প্রতিনিয়তই বড় মাছের চেয়ে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছের বাজারে ভিড় থাকলেও পর্যাপ্ত মাছ নেই আবার মাছ থাকলেও উচ্চমূল্যের বাজারে ক্রয়ক্ষমতা স্বল্প মানুষের। small-fish-bg20120229064047
সরেজমিনে বাজার ঘুরে জানা যায়, শৈলকুপার বেশিরভাগ মৎস্য ব্যবসায়ীরা ঋণগ্রস্ত এবং নিজেদের জাল থাকলেও জল নেই, নেই খাল-বিল, নদ-নদীতে মাছ ধরার কোন উপায়। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাকৃতিক মাছ দেহগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাজারে আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন এ সমৃদ্ধ চিরচেনা ছোট মাছের বাজার ব্যাপক চড়া। চাপিলা, চেলাপুটি, খয়রা, কৈ, শিং, মাগুর, ফেসা, রূপচাঁদা, দারকুনো, রয়না, পিয়ালী, বেলে, টেংরা, সরপুটি বাজারে নেই বলেই চলে। তবে ছোট চিংড়ি, পুটি, বাইম ও চাঁদা মাছের দেখা মিললেও একজন মৎস্যজীবীর নিকট ২ কেজির বেশি কল্পনা করা যায় না। দামও সাইজভেদে ১শ’ থেকে ৮শ’ টাকা কেজি। দেশীয় প্রজাতির ভাল কৈ, শিং ও জিয়লের কেজি ৫-৮শ’ টাকা দাম হাঁকানো হলেও বাজারে পর্যাপ্ত নেই। হাতেগোনা দু-চার কেজি চাপিলা, পিয়ালী, টেংরা বিক্রি হলেও প্রতি কেজি ৭-৮শ’ টাকা। তাছাড়া রোজার বাজারে ছোট মাছ মেলতে না মেলতেই বেচাকেনা শেষ হয় প্রথম ভাগেই। শরীরের ৭৮ভাগ প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পূরণে সক্ষম এ সকল ছোট প্রজাতির মাছ সংকটের অন্যতম কারণ পানি ও নদ-নদীতে কারেন্ট জালের ব্যবহার, মা মাছ ধরাকে দায়ী করা হলেও নিত্যানন্দনপুর বাওড় এলাকার জেলে হরেন কুমার জানান, স্বল্প মেয়াদীতে জলাশয় ইজারা দেয়ায় মৎস্যচাষীরা বছর শেষে খামারে বিষ প্রয়োগ করে অতিঅল্প সময়ে বেশি লাভের আশায় রুই, কাতলা, মৃগেলসহ বড় বড় মাছের চাষ করে। যে কারণে প্রাকৃতিক মাছের ডিম ছাড়ার সময় বেশিরভাগ ছোট মাছ মারা পড়ে যায়। জেলেদের পাশাপাশি গ্রামীণ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত অনেকেই সখেরবশে কিংবা জীবিকার তাগিদে এ পেশায় ঝুঁকে পড়লেও আশানুরূপ মাছ নেই। তারা দোয়ারী, ঘুনি, ধর্মজাল, বেড়া জাল, পাতজাল, খেপলা, কারেন্টজাল ব্যবহার করে ছোট প্রজাতির বিভিন্ন মাছ ধরলেও আজকাল বিল-বাওড়, মাঠ-ঘাটে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এসব মাছ ধরার যন্ত্রের চাহিদাও কম। এছাড়াও শিয়াল, ভোদর, সাপ, কচ্ছপ, মাছরাঙা, বক, চিল, পানকৌড়ির আক্রমণে কয়েক প্রজাতির ছোটমাছ এখন বিলুপ্তির পথে। সেকেলে প্রত্যন্তপল্লীর মানুষ চাহিদা মিটিয়ে বর্ষা মৌসুমের অতিরিক্ত মাছ শুকিয়ে সংরক্ষণ করতো এখন তা কল্পনাতীত। ৯০ দশকে যার কমতি ছিল না। ‘মাছে ভাতে বাঙালী’ একটি অতীত ঐহিত্য হারিয়ে বিলুপ্তপ্রায় ২০ প্রজাতির ছোটমাছ সংকটে পড়া শুধু শৈলকুপাবাসী নয়। দেশের বহু অঞ্চলেই এর প্রভাব লক্ষণীয়।  শৈলকুপা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা শামছুজ্জামান বলেন, দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ করতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন, বর্ষা মৌসুমে মা মাছ নিধন, প্রাকৃতিক মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংক্ষরণ, জেলেদের এসব মাছ ধরা থেকে বিরত রাখা, কীটনাশক ব্যবহার কমানো ও উন্মুক্ত জলাশয় দীর্ঘমেয়াদী ইজারার মাধ্যমে প্রাকৃতিক মাছ সংরক্ষণ করা সম্ভব। তাছাড়া এর উপকারিতা সম্পর্কে জনসচতেনতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো প্রয়োজন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics