সবুজ ময়ূর

সবুজ ময়ূর (Pavo muticus) (ইংরেজি: Green Peafowl) বা বর্মী ময়ূর Phasianidae (ফ্যাসিয়ানিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Pavo (পাভো) গণের অসাধারণ সুন্দর, ঝলমলে রাজকীয় ময়ূর। সবুজ ময়ূরের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ ছোট ময়ূর (ল্যাটিন: pavo = ময়ূর; muticus = ছোট, ক্ষুদে বা সংক্ষিপ্ত)। বিগত কয়েক দশকে এদের সংখ্যা ভয়াবহভাবে হ্রাস পেয়েছে। সেকারণেআই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে Endengered বা বিপন্ন বলে ঘোষণা করেছে।বাংলাদেশে একসময় এরা প্রচুর পরিমাণে থাকলেও সম্প্রতি এদের দেখতে পাওয়ার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ নেই। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

800px-London_Zoo_00863এক সময় সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে সবুজ ময়ূরের অবাধ বিস্তার ছিল। বাংলাদেশে ১৯৪০ এর দশকেও সবুজ ময়ূর চট্টগ্রাম ওপার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিল। এখনও বান্দরবানের গহীন বনে সবুজ ময়ূর থাকতে পারে।

এ পর্যন্ত সবুজ ময়ূরের মোট তিনটি উপপ্রজাতি সনাক্ত করা গেছে। যার মধ্যে বাংলাদেশে পাওয়া যায় P. m. spicifer । অন্য   দুটি  হল  P. m.imperator  ও   P. m. muticus

সবুজ ময়ূর দেখতে অনেকটা নীল ময়ূরের মতই, তবে শরীরে ঝলমলে ধাতব সবুজ পালকের আধিক্য রয়েছে। এরা বেশ বড় আকারের ভূচর পাখি। এদের দৈর্ঘ্য ১০০-৩০০ সেন্টিমিটার, ডানা ৪৫ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৪.ত সেন্টিমিটার, পা ১৫.২ সেন্টিমিটার, লেজ ৪.৩ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৪.৫ কিলোগ্রাম। পুরুষ ময়ূরের পেখম ১৫০ সেন্টিমিটার। পুরুষ ময়ূরের চেহারা ও আকার স্ত্রী পাখির থেকে কিছুটা আলাদা। পুরুষ ময়ূরের পিঠ ও ঘাড় সবুজ; ঘাড়, গলা ও বুকের পালক আঁশের মত উঁচু। পালকহীন মুখের চামড়া নীল ও হলুদে মেশানো। ডানা-ঢাকনি সবুজ রঙের। ডানার মধ্যভাগ ও গোড়ার পালক বাদামি; লেজের পেখমের প্রান্তে কালো চক্রের মধ্যে বেগুনী ফোঁটা দেখা যায়। দেহতলে সরু কালো ধাতব তামাটে, সবুজ ও বেগুনী দাগ থাকে। এমনিতে স্ত্রী ময়ূর বা ময়ূরীর চেহারা সামনে থেকে পুরুষ ময়ূরের মতই, তবে দেহের কিছু কিছু অংশ ফ্যাকাসে। পিঠ গাঢ় বাদামি বর্ণের। লেজ পেখমহীন। ডানা-ঢাকনি, পিঠের শেষভাগ ও কোমর কালচে বাদামি। লেজে পীতাভ, বাদামি ও কালো রঙের ডোরা আছে। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় ময়ূরের সুঁচালো ও বিপরীতমুখী। চোখ কালো, পা ও ঠোঁট ধূসর। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে ময়ূরীর মত, কেবল কোমরে সবুজাভ ও তামাটে বর্ণ থাকে না।

সবজ ময়ূর সাধারণত ছোট দলে বিচরণ করে; এক একটি দলে একটিমাত্র পুরুষ ময়ূর ও তিন থেকে পাঁচটি ময়ূরী থাকে। এরা স্বভাবে দিবাচর, তবে ভোরবেলা আর গোধূলিতে বেশি সক্রিয় থাকে। জোরে ডানা ঝাপটে এরা দ্রুত উড়তে পারে। এক ময়ূরের ডাকের জবাবে অন্য ময়ূরও ডেকে ওঠে। বেশিরভাগ এলাকাতেই এরা লাজুক স্বভাবের এবং কাছে গেলেই লুকিয়ে পড়ে বা উড়ে যায়। তবে যেসব এলাকায় এদের তেমন একটা ক্ষতি করা হয় না, সেসব এলাকায় এরা মানুষের আশেপাশে পোষা পাখির মত ঘুরে বেড়ায়।

সবুজ ময়ূরের বিচরণ সমূদ্রসমতল থেকে সর্বোচ্চ ৩০০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত হয়। সবুজ ময়ূর প্রধানত হালকা বনভূমি, বনভূমি সংলগ্ন ঘাসবন ও খোলা জায়গা, সাভানা, বনসংলগ্ন নদীর পাড়, ক্ষেতখামার ইত্যাদি এলাকায় খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। অনেকসময় গৃহপালিত হাঁস-মুরগীর সাথে ঘুরে ঘুরে খাবার খায়। এদের জীবনধারণের জন্য প্রচুর পানির দরকার হয়, সেকারণে পানির উৎসের আশেপাশেই এদের দেখা যায়।

এদের জাতভাই নীল ময়ূরের মত সবুজ ময়ূরও সর্বভূক। খাদ্যতালিকায় রয়েছে বীজ, শস্যদানা (মূলত ধান), তৃণ, কচি উদ্ভিদের কান্ড, গাছের পাতা, ফুলের কলি, রসালো ফল ইত্যাদি। এছাড়া এরা ঘাসফড়িং, গুবরে পোকা, মথ, ফড়িং, ঝিঁঝিঁ পোকাসহ বিভিন্ন জাতের পোকামাকড়, ব্যাঙ, গিরগিটি ও ছোট সাপ খায়। মটরশুঁটি আর মিষ্টি আলুর মৌসুমে এরা ক্ষেতে হানা দিয়ে ফসল সাবাড় করে। মাটি আঁচড়ে, ঝরা-পাতা উল্টে এরা বনতলে খাবার খুঁজে বেড়ায়।

দিও একটি ময়ূরকে ঘিরে একাধিক ময়ূরী নিয়ে একটি দল তৈরি করার ব্যাপারটা জানা যায়, তবুও দলগুলো স্থায়ী হয় না। প্রকৃতপক্ষে ময়ূর তার এলাকায় অনুপ্রবেশকারী একটি ময়ূরীর (কখনও কখনও একাধিক, তবে এমনটি কমই ঘটে) সাথে জোড়া বাঁধে। আর বাকি ‘ময়ূরীরা’ আসলে অপ্রাপ্তবয়স্ক ময়ূর যারা ঐ ময়ূরীর সন্তানমাত্র। আবদ্ধ অবস্থায় সবুজ ময়ূরের একগামী স্বভাবের মাধ্যমে একথার সত্যতা মেলে।

জানুয়ারি থেকে মে এদের প্রধান প্রজননকাল। প্রজননকালে পুরুষ ময়ূরেরা কঠিনভাবে তাদের নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিটি ময়ূর তার প্রতিবেশী ময়ূরের থেকে ১০০ থেকে ৪০০ মিটারের মত দূরত্ব বজায় রাখে। এসময় এরা পেখম মেলে ও ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে ময়ূরীর দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে। ময়ূরী একাই বাসা বানাবার জন্য জায়গা নির্ধারণ করে এবং ঘন ঝোপের নিচে মাটিতে বাসা করে। বাসা বানানো শেষে ৩-৮টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলোর বর্ণ পীতাভ। ডিমগুলোর মাপ ৭.২ × ৫.৩ সেন্টিমিটার। কেবল স্ত্রী ময়ূর ডিমে তা দেয়। ২৬-২৮ দিন পর ডিম ফুটে ছানা বের হয়। ছানারা খুব কম বয়সেই উড়তে শিখে যায়। অপ্রাপ্তবয়স্করা মায়ের সাথে ঘুরে বেড়ায়। সাধারণত ময়ূর দুই বছরে এবং ময়ূরী এক বছরে বয়োঃপ্রাপ্ত হয় ।

সবুজ ময়ূর খুব সরব পাখি। একটু শব্দ হলে বা বিশ্রামের সময়ে এরা ডেকে ওঠে। ফলে এরা শিকারীর সহজ শিকারে পরিণত হয়। আবার বড়সড় আকার ও ঝলমলে পালকের জন্য এরা খুব সহজেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। নির্বিচারে শিকারের ফলে দিন দিন এরা সংখ্যায় কমে যাচ্ছে। এছাড়া বেআইনী ব্যবসা, আবাসস্থল ধ্বংস, বিচ্ছিন্ন বিস্তৃতি, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, রোগবালাই, পরিবেশ দূষণ ও কীটনাশকের অবাধ ব্যবহারের ফলে সারা বিশ্বে সবুজ ময়ূর আশংকাজনক হারে কমে যাচ্ছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics