সভ্যতার জটিল সমীকরণ ; আলোক দূষণ !!!!

তানভীর হোসেন

পূর্ণিমার রাতে অজস্র তারার সাথে চাঁদের যোগসাজশ একটি অপূর্ব মোহনীয় আবহ তৈরী করে। এরকম এক রাতে মা তার শিশুকে চাঁদ মামার গল্প শুনিয়ে ঘুম পাডায়। এসবই যেন এখনকার দিনে রুপকথার গল্পে ফানুস হয়ে উড়ে যাচ্ছে। মানুষ রাতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে আজ ব্যাহত করছে বিভিন্ন আলোকপ্রযুক্তির অতিব্যবহারে, আর দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ যে আলো, তার অতি ব্যবহার তৈরি করছে দূষণ!!!  রাতের স্বাভাবিক ধর্মকে বিনষ্ট করে আলোর পরিকল্পনাহীন ব্যাবহারের নামই আলোক দূষণ নামে পরিচিত। বর্তমানে গ্রাম বাংলার আকাশ এবং শহর এলাকার আকাশে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। গ্রামীন আকাশে অধিকাংশ তারকাই উজ্জ্বল ও দৃশ্যমান হয় যা শহুরে আকাশে প্রায় দূর্লভ হয়ে গেছে।17-toronto-aerial-night-665 এর প্রধান কারণ হচ্ছে আলোক দূষণ যা আজ বিজ্ঞানী এবং পরিবেশকর্মীদের কাছে একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক রাত্রির-আকাশ বিষয়ক সমিতির সংজ্ঞামতে, তপ্ত আকাশ, তীব্র আলো, আলোর অনুপ্রবেশ, বিশৃংখল আলো, রাতের অপ্রতুল দৃশ্যমানতা এবং শক্তির অপচয়সহ যে কোনো ধরনের কৃত্রিম আলোর ক্ষতিকর প্রভাবকে আলোক দুষণ বলে গণ্য করা হবে। কৃত্রিম আলো যখন রাত্রিকালের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অনুপ্রবেশ করে তখনই ঘটে আলোক দুষণ । এটি নগর এলাকায়ই বেশি প্রকট যেখানে শহুরে বাতিগুলো রাতের তারা ও গ্রহগুলোকে অদৃশ্য করে দেয়। উপগ্রহ ছবিতে রাতের নাগরিক এলাকার চারদিক দুষিত আলোর তপ্ত প্রতিবেশ হিসেবে প্রতীয়মান হয়।

আলোক দুষণের কার

বাহ্যিক আলোর উর্ধমুখী বা পার্শমুখী পরিচলনের ফলে আলোর দুষণ ঘটে যেখান থেকে আলো বায়ুমন্ডলে যায় এবং আবার ভুমিতে ফিরে আসে। বায়ুমন্ডলের কনিকাগুলো আলোর বিচ্ছুরন তরান্বিত করে আলোক দুষণকে তীব্র আকারে পরিনত করে। আন্তর্জাতিক রাত্রির-আকাশ বিষয়ক সমিতির মতে, নীল আলোর অধিকতর আলোক বিচ্ছুরন ক্ষমতার কারণে, যেসব উৎস নীল আলো নিঃসরন করে সেগুলোই রাতের আকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে আলো ব্যবহার করি তাও আলোক দূষণের একটি অন্যতম কারন।

প্রভাব

আমেরিকার ন্যাশনাল পার্ক সার্ভিসের মতে,যুক্তরাষ্ট্রের সিটিগুলো প্রায় ২০০ মাইল পর্যন্ত আলো নিসঃরন করে যা রাতের আকাশের দৃশ্যমানতা নষ্ট করে। আলোক দুষণ সবচেয়ে বেশি সমস্যা সৃষ্টি করে আকাশ পর্যবেক্ষকদের; যারা কৃত্রিম আলোর কারণে তারকা এবং গ্রহগুলোকে পৃথক করতে সমস্যার সম্মুখীন হোন, যার কারণে এই অতিরিক্ত আলো মহাকাশের বস্তুসমুহের দৃশ্যমানতা হ্রাস করে। আলোক দুষণ অর্থনীতিতেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে যার উদাহরস্বরুপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষক ওলসেনের বক্তব্য। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয়িত শক্তির ২৫% ব্যবহৃত হয় আলোকসজ্জার জন্য যার ৩০% ই আলোকদূষণ হিসেবে অপচয় হয়।  প্রাণীকুলের উপর আলোকদূষণের প্রভাব খুব প্রকট। পৃথিবীতে অধিকাংশ প্রাণীই পর্যায়ভিত্তিক আলোক ও অন্ধকারের উপর নির্ভরশীল। জীববিজ্ঞানীরা নিশাচর প্রাণীদের জীববৈচিত্র্য নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন কেননা, আলোকদূষণ বহু প্রজাতিকে বিলুপ্তির পথে ধাবিত করছে। গত জুনে সিএনএন এর একটি রিপোর্টে বলা হয়, মাইকেল জ্যাকসন তার জীবনের শেষ দিকে ৬০ টিরও অধিক রাত ঘুমের REM বা র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট পর্যায় ছাড়াই কাটিয়েছেন।light-pollution-animals-hps-lighting-interference_123512 র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট বা দ্রুত চক্ষু ঘূর্ণন এমন একটি পর্যায় যখন মানুষ স্বপ্ন দেখে। এই থেকে গবেষক মিশেল প্রশ্ন রেখেছেন যে, REM পর্যায়ের ঘুমের অভাব কি মানুষের শারিরীক ও মানষিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে না? তিনি বলেন, যখন মানুষ রাতের বেলায় ভালো করে ঘুমায় না তখন তার হরমোনের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। নারীদের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি ভয়াবহ যা তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অন্যান্য হরমোনের বা ঘুমের সাথে সম্পর্কিত দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন নিদ্রাহীনতা, বহুমুত্ত্র, মাথাব্যথা, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদিও পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে হয়ে থাকে। অপর্যাপ্ত ঘুম মানুষের মেলাটোনিন হরমোনের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। মেলাটনিনের মাত্রা কম থাকলে তা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

আলোকদূষণ এখন আর অবহেলার কোনো বিষয় নয় বরং এটি বিজ্ঞানী,পরিবেশকর্মী, চিকিৎসক সহ সচেতন মহলকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তুলেছে। এর প্রতিকারের জন্য আমাদেরই নিজ নিজ ক্ষেত্র থেকে সচেতন হতে হবে। উন্মুক্ত জায়গায় আলো জালালে আমাদেরকেই এর নিম্নমুখী পরিচলন নিশ্চিত করতে হবে। তীব্র আলোর বাতি ব্যবহারের পরিবর্তে তুলনামুলক কম তীব্র বাতি ব্যবহার করা উচিৎ এবং সাদা বাতি যেগুলো নীল আলোর কম নিঃসরন ঘটায় সেগুলোর ব্যবহার বাড়াতে হবে। তবে আলোর অনভিপ্রেত উপস্থিতি ঠেকানো এবং শক্তির অপচয় রোধ করার কার্যকরী উপায় হচ্ছে প্রয়োজন ব্যতিরেকে আলোর উৎস নিভিয়ে রাখা। এভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই আলোকদূষণের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারি।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম

০৫/০৯/২০১৩

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics