সমুদ্র সম্পদ ব্যবস্থাপনায় “ সমুদ্র কমিশন ” গঠনের প্রস্তাব

সম্ভবনাময় সমুদ্র সম্পদ জরিপ, গবেষণা, অনুসন্ধান, উত্তোলন, পরিকল্পিত ব্যবহার এবং পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদী রূপরেখা প্রণয়ন জরুরী। এসব কার্যক্রম সমন্বয় ও মনিটর করা এবং সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা ও উন্নয়নে সরকারি নীতি প্রণয়নের লক্ষে জাতীয় পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সমুদ্র কমিশন গঠন করতে হবে। আজ ২২ জুলাই ২০১৪, মঙ্গলবার, সকাল ১১টায়, পবা কার্যালয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) আয়োজিত “বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ ব্যবস্থাপনায় করণীয়” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়- মিয়ানমার ও ভারতের সাথে দীর্ঘদিনের অনিষ্পন্ন সমুদ্র সীমা নিষ্পত্তির ফলে বাংলাদেশ বিশাল সামুদ্রিক অঞ্চলের সম্পদের উপর একচ্ছত্র অধিকার পায়। যা এদেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণে সমুদ্র সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারকে নিশ্চিত করার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নের পথকে সুগম করেছে। বঙ্গোপসাগর অববাহিকায় ৪০০ মিলিয়নের বেশী মানুষ বসবাস করে। এসব মানুষ তাদের খাদ্য, জীবিকা ও নিরাপত্তার জন্য উপক’লীয় ও সামুদ্রিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। বঙ্গোপসাগর ইকোসিস্টেমকে যেসব বিষয় প্রভাবিত করে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে – আন্তসীমানা বিষয়, মৎস্য সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ, গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থলের অবনতি, দূষণ ও পানির মান।

আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধের ১৪ মার্চ ২০১২ সালের  এবং স্থায়ী সালিশী আদালতে ( পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন- পিসিএ) বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা বিরোধের ৭ জুলাই ২০১৪ সালের  রায়ের ফলে বাংলাদেশ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে ১২ নটিক্যাল মাইলের রাষ্ট্রাধীন সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত একচ্ছত্র অর্থনেতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপক’ল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সকল প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।DSC_6882

সমুদ্রসীমা  নির্ধারিত হওয়ায় দেশের সামুদ্রিক মানচিত্র প্রণয়নের পাশাপাশি সম্পদ আহরণ ও সমুদ্র এলাকার নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কিছু হুমকি ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ২১ শতকের সামুদ্রিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো হলোঃ সামুদ্রিক সীমানা বিরোধ, আন্ত রাষ্ট্র দ্বন্ধ, জলদস্যুতা, সামুদ্রিক সন্ত্রাসবাদ, অবৈধ অস্ত্র বাণিজ্য, মানব পাচার, সামুদ্রিক দূষণ, সমুদ্রে যোগাযোগ সুরক্ষা, সমুদ্রবাহিত বাণিজ্য, মাদক পাচার, সামুদ্রিক সহযোগিতা, ঢ়ৎবংবৎাধঃরড়হ ড়ভ ষরারহম ধহফ হড়হ-ষরারহম ৎবংড়ঁৎপবং, সামুদ্রিক অনুসন্ধান ও রেসকিউ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন।

সমুদ্রের বিশাল জলরাশি এবং এর তলদেশের জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক সম্পদ বাংলাদেশের বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখতে সক্ষম হবে। সমুদ্র সম্পদের নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা প্রথম বাধা অতিক্রম করেছি। পরবর্তী ধাপ হচ্ছে সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার ও তা সুরক্ষা করা। বঙ্গোপসাগর সম্পদে পরিপূর্ণ। এখানে বিভিন্ন ধরনের মাছ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- গ্যাস, তেল ও খনিজ সম্পদ রয়েছে। সমুদ্রের লোনা পানি হতে লবন উৎপাদন ছাড়াও আমাদের সমুদ্র সৈকতে প্রাপÍ খনিজ সম্পদ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের পাশাপশি রপ্তানি খাতে নতুন সম্ভাবনা উম্মোচন করবে। শতকরা ৯০ ভাগ বাণিজ্য সমুদ্র পথে হয়ে থাকে। এছাড়া বায়ু প্রবাহ ও সমুদ্র ¯্রােতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এসব কারণে বঙ্গোপসাগর অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্র অঞ্চল ও এর পরিবেশ রক্ষা এবং সম্পদের টেকসই আহরণের জন্য একটি বহুমুখী পরিকল্পনা প্রয়োজন।

সংবাদ সম্মেলনে প্রবন্ধের আলোকে মূল বক্তব্য তুলে ধরেন পবা নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান, বক্তব্য রাখেন পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মনোয়ার হোসেন, সম্পাদক এডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী, সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের সাবেক ডিজিএম সৈয়দ আফরোজ আশরাফ,  পীসের মহাসচিব ইফমা হুসাইন, পবার নির্বাহী সদস্য মো: সেলিম, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত প্রমুখ।

সুপারিশসমূহ-
১.    সমুদ্র অঞ্চল ও এর পরিবেশ রক্ষা এবং সম্পদের টেকসই আহরণের জন্য একটি বহুমুখী পরিকল্পনা প্রয়োজন। সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কার্যক্রম সমন্বয় ও মনিটর করা এবং সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা ও উন্নয়নে সরকারি নীতি প্রণয়নের লক্ষে জাতীয় পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সমুদ্র কমিশন গঠন করা ।
২.    সমুদ্রে অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে জরুরিভিত্তিতে উপযুক্ত ও ব্যাপকভিত্তিক সমুদ্রনীতি ও কর্মকৌশল প্রণয়ন করা।
৩.    ২০৫০ সালকে টার্গেট করে একটি সমুদ্র রুপকল্প তৈরী করা।
৪.    জরুরি ভিত্তিতে সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদের সঠিক জরিপ করা।
৫.    দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ করা এবং সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিতকরণ। বিদেশী কোম্পানিগুলোর সাথে গ্যাস চুক্তি করার সময় জনগণের স্বার্থ যেন রক্ষিত হয় তা নিশ্চিত করা।
৬.    সমুদ্রের তলদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের মাধ্যমে দেশের দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
৭.    বঙ্গোপসাগর প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিশাল ভান্ডার। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ, দীর্ঘমেয়াদী জ্বালানী নিরাপত্তা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে এই সম্পদের আহরণ ও ব্যবহার নিশ্চিতকরণ।
৮.    সমুদ্র পথে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং মৎস্য ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুরক্ষায় নৌবাহিনীকে  এবং উপক’লীয় অঞ্চলে দেশী-বিদেশী জাহাজে দস্যুতা প্রতিরোধের লক্ষে কোস্টগার্ডকে শক্তিশালী করা।
৯.    সমুদ্র ও সমুদ্রতীরবর্তী এলাকার জীববৈচিএ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সমুদ্র দূষণমুক্ত রাখা।
১০.    গ্রিনহাউস গ্যাস উদগিরণ ও অন্যান্য কারণে বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের লবণাক্ততা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ছাড়াও অনেক কারণে সমুদ্রের দূষণ বৃদ্ধি পেয়ে জীবন, সম্পদ ও প্রকৃতির ভারসাম্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। দূষণের উৎস চিহ্নিত করে এগুলো মোকাবিলা করা ।
১১.    সমুদ্র বিজ্ঞান ও সম্পদের গবেষণা এবং অধ্যয়ন ত্বরাম্বিত করার লক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুত চালু করা।
১২.    সমুদ্রবিজ্ঞান, সমুদসম্পদ ও পরিবেশ বিষয়ে অধিকতর গবেষণা ও অধ্যয়ন প্রয়োজন। ঢাকা, চট্রগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে আলাদা বিভাগ বা ইনস্টিটিউট থাকলেও তা  অপ্রতুল। সমুদ্র ও সমুদ্রসম্পদকে কার্যকরভাবে ব্যবহারের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষে সব বিশ্ববিদ্যালয়েই কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
১৩.    কক্সবাজারে জাতীয় সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কাজ বহুদিন থেকে চলছে, কিন্তু অত্যন্ত ধীর গতিতে। ইনস্টিটিউটটি দ্রুত চালরু ব্যবস্থা করা।
১৪.    পক্ষরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রীয় সমুদ্র ও সামুদ্রিক অঞ্চলবিষয়ক আইন ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ডধঃবৎং ধহফ গধৎরঃরসব তড়হবং অপঃ -১৯৭৪ সংশোধন করে তা ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা।
১৫.    মিয়ানমার ও ভারত সাথে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।

এনভাইরনমেন্টমুভ ডটকম ডেস্ক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics