সরকারের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ার সুযোগে খাদ্যে ফরমালিন অব্যাহত রয়েছে: পবা

খাদ্যদ্রব্যে বিষ ও ভেজালের ব্যাপকতার বিপরীতে মৌসুমী  ফলে ও রমজানের সময় মোবাইল কোর্ট ও ঢাকায় প্রবেশমুখে ফরমালিন পরীক্ষার অভিযান পরিচালিত হলেও এখন তা ঝিমিয়ে পড়েছে। নিরাপদ খাদ্য আইন বাস্তবায়ন, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন জারিসহ ফলমূল ও খাদ্যদ্রব্য নিরাপদ করতে সরকারের কার্যক্রম থমকে গেছে। এতে ভোক্তা সাধারণ বাজারে বিদ্যমান খাদ্যদ্রব্য বিষমুক্ত, নিরাপদ কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারছেন না। সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ফলমূলের ফরমালিন পরীক্ষা করে তার একটি চিত্র তুলে ধরতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) আয়োজিত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪, বুধবার, সকাল: ১১ টায় পবা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে উক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়- বাংলাদেশের জনগণের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার প্রথমটি খাদ্য। কিন্তু সেই খাদ্যে সামান্য মুনাফার লোভে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশিয়ে ধীরে ধীরে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। উৎপাদন থেকে বাজারজাতকরণ প্রত্যেকটি স্তরেই এর ছড়াছড়ি রয়েছে। সহজপ্রাপ্যতা, আইনী দুর্বলতা আর যথাযথ নজরদারির অভাবে এসব ঘটেই চলেছে, যাতে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে। মহামান্য হাইকোর্ট ২ বছরের মধ্যে সকল জেলায় খাদ্য আদালত স্থাপন এবং পর্যাপ্ত খাদ্য পর্যবেক্ষক নিয়োগের জন্য সরকারকে ০১ জুন ২০০৯ নির্দেশ প্রদান করে। খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫ বছরেরও বেশী  আগে প্রদত্ত হাইকোর্টের নির্দেশের  প্রেক্ষিতে  প্রতি জেলায় খাদ্য আদালত স্থাপন এবং খাদ্য পর্যবেক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক কার্যকর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় নি। DSC_0670

ঢাকা মহানগরে দেশী ও বিদেশী ফলে ফরমালিনের বর্তমান অবস্থা নিরুপণের লক্ষে ০৭ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত আম, আপেল, আঙ্গুর, মালটা, কমলা, কলা, পেয়ারা, ডালিম, আনারস, আমড়া ও জাম্বুরা এবং আটা ও সেমাইয়ে ফরমালিন পরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ কার্যক্রমের আওতায় ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আমের ৯টি, আপেলের ২৩টি, আঙ্গুরের ৭টি, মালটার ১৪টি, কমলার ৮টি, কলার ১১টি, পেয়ারার ৮টি, ডালিমের ১০টি, আনারসের ৫টি, আমড়ার ৮টি ও জম্বুরার ৫টি (মোট(১০৮টি) এবং আটার ১৫টি ও সেমাইয়ের ৯টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এসব ফল বিভিন্ন বাজার ও এলাকা হতে ক্রয় করে পবা কার্যালয়ে পরীক্ষা করা হয়।

পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়- আমের ৯টি নমুনার মধ্যে ৬টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ৬৭ শতাংশ; আপেলের ২৩টি নমুনার মধ্যে ৯টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ৩৯ শতাংশ; আঙ্গুরের ৭টি নমুনার মধ্যে ৪টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ৫৭ শতাংশ; মালটার ১৪টি নমুনার মধ্যে ১০টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ৭১ শতাংশ; কমলার ৮টি নমুনার মধ্যে ৬টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ৭৫ শতাংশ; কলার ১১টি নমুনার মধ্যে ৬টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ৫৫ শতাংশ; পেয়ারার ৮টি নমুনার মধ্যে ২টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ২৫ শতাংশ; ডালিমের ৯টি নমুনার মধ্যে ৪টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ৪৪ শতাংশ; আনারসের ৫টি নমুনার মধ্যে ৪টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ৮০ শতাংশ; আমার ৮টি নমুনার মধ্যে ২টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ২৫ শতাংশ; জাম্বুরার ৫টি নমুনার মধ্যে ১টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছেযা মোট নমুনার ২০ শতাংশ; আটার ১৫টি নমুনার মধ্যে ১৩টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ৮৭ শতাংশ; সেমাইয়ের ৯টি নমুনার মধ্যে ৭টি নমুনায় ফরমালিনের উপস্থিতি রয়েছে যা মোট নমুনার ৭৮ শতাংশ।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধের আলোকে বক্তব্য তুলে ধরেন পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মোঃ আবদুস সোবহান। উপস্থিত ছিলেন পবার সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, নির্বাহী সদস্য মো: সেলিম, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের শিক্ষক পদ্মাদেবী, পরিবেশ সাংস্কৃতি মঞ্চের পরিচালক মিজান শরীফ খোকা, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদের সভাপতি মো: মুসা প্রমুখ।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে মো: আবদুস সোবহান জানান, সরকার ফরমালিন বিরোধী অভিযানে যে মেশিন ব্যবহার করে পবা সে মেশিন দিয়ে ফরমালিন পরীক্ষা করেছে। একই সাথে ক্রোমোটোপিক এসিড দিয়েও পরীক্ষা করে নিশ্চিত হচ্ছে।
বিসিএসআইআরকে জনস্বার্থে আরও বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া উচিত ছিল। সারা দেশ যখন ফরমালিন আতংকে ভুগছে  বিসিএসআইআর এ বিষয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। বিসিএসআইআর মাছ ও দুধের ফরমালিন পরীক্ষার যে কিট ব্যবহার করে ৫পিপিএম এর উর্দ্ধে ফরমালিন থাকলেই কেবল তা শনাক্ত করতে পারে। অথচ বিশুদ্ধ খাদ্য আইন ২০০৫ -এ খাদ্যদ্রব্যে যেকোন মাত্রার ফরমালিন মিশানো ও ফরমালিন মিশ্রিত খাদ্যদ্রব্য বিক্রি আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। একই সাথে বিসিএসইআইআর এর ফরমালিন শনাক্তকরণ কীটের গায়ে এই মাত্রার বিষয়টিও উল্লেখ নাই। এটা ফরমালিন ব্যবহারকারীদের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে। জনগণের টাকায় পরিচালিত বিসিএসআইআর এর খাদ্য গবেষণাগারকে যন্ত্রপাতিসহ তার সক্ষমতার জনস্বার্থে সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। ফরমালিনসহ ও বিভিন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি পরিমাণসহ নিরুপণের জন্য সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার ও বিদ্যমান আইনের আলোকে সাধারণ জনগণের ব্যবহারযোগ্য করে তোলার বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

সুপারিশঃ
সরকার খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন ব্যবহারকারীদেরকে মোবাইল কোর্টের পাশাপাশি বিদ্যমান আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে এবং নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ বাস্তবায়নে জরুরীভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিন মিশানোর সাথে জড়িত ও ফরমালিনযুক্ত খাদ্য বিক্রয়কারীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দন্ড প্রদানই যথেষ্ট নয়।  এদের বিরুদ্ধে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ১৯৭৪ এর ২৫-গ ধারা প্রয়োগ করা যেতে পারে।
সময়োপযোগী কীটনাশক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা ।
মন্ত্রি পরিষদ কর্তৃক ৩০ জুন ২০১৪ তারিখে অনুমোদিত ‘ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন(খসড়া)’ ২০১৪ দ্রুততম সময়ে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন ও জারী করা এবং এ আইনে ফরমালিনের সহনীয় মাত্রা না রাখা।
দেশের চাহিদা অনুযায়ী টিসিবির মাধ্যমে ফরমালিন আমাদানি করা।
পণ্য আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদিসহ ফরমালিন পরীক্ষা করা।
দেশের বিদ্যমান গবেষণাগারসমূহের সক্ষমতা অনুযায়ী সেগুলোকে খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি, ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড পরীক্ষার নির্দেশনা প্রদান করা এবং একটি আধুনিক গবেষণাগার স্থাপন করা।
কোন রকম রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশের  প্রেক্ষিতে  প্রতি জেলায় খাদ্য আদালত স্থাপন এবং খাদ্য পর্যবেক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা ।
খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা।
খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং পরিদর্শন ও এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনায় সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের সাধন।
Stockholm Convention on Persistent Organic Pollutants স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে The “Dirty Dozen” এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে জরুরী ভিত্তিতে কার্যক্রম গ্রহণ করা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics