সারি নদী কি পথ হারাবে ??
আল মারুফ রাসেল
ভারতের মেঘালয়ে মাইনথ্রুং, বাংলাদেশে সারি। এর দুই তীরে গড়ে উঠেছে জনপদ, বন আর কৃষিজমি। কিন্তু নদীটি টিকবে তো? এই প্রশ্নের কারণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারত আটকে দিচ্ছে এর স্রোত।
অনেক আগের কথা। বন-বনানী আর পাহাড়ঘেরা রাজ্য ছিল জৈন্তা। সব ভালোর জৈন্তায় একটাই খারাপ ছিল, পাশের যে নদী, তাতে ঘোর বর্ষায় তলিয়ে যেত সব ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠ। তাই জৈন্তার রানি পাথর কাটিয়ে নদীর গতিপথ বদলে দেন, সৃষ্টি হয় নতুন খাতের। এমন গল্পই শোনা যায় সারি নদী নিয়ে, স্থানীয়দের কাছে। প্রমাণ হিসেবে লালাখালের ডুবন্ত এক পাথর দেখিয়ে দেয় তারা।
ভারতের মেঘালয়ের কোনো এক পাহাড় থেকে উৎসারিত পানির ধারা মাইনথ্রু নামে ছুটে এসেছে ভাটির দিকে। সিলেটের জৈন্তাপুরে যখন এই ধারা প্রবেশ করে, তখন এর নাম হয় সারি নদী। গোয়াইনঘাটের অদূরে গোয়াইন নদী মিশেছে এই ধারার সঙ্গে, আর উভয়ের মিলিত স্রোত ছাতকে এসে সুরমা নদীর সঙ্গে মিশেছে।
সারি নদী স্থানীয় অর্থনীতিতে এক অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে বহু আগে থেকেই। মেঘালয়ের পাহাড় থেকে স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা পলি এই অঞ্চলকে উর্বরতা যেমন দিয়েছে, তেমনি সীমান্তবর্তী চা-বাগানে প্রয়োজনীয় পানির চাহিদাও পূরণ করছে। নদীর স্রোতে ভেসে আসা পাথর সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে স্থানীয় বাসিন্দারা। আর আসে বালু, ঘরবাড়ি তৈরিতে যে সিলেট স্যান্ডের ব্যবহার হয়, তার সিংহভাগই আসে সারির কোল থেকে। এ নদীর আরও একটি অবদান রয়েছে পর্যটনশিল্পে। এর স্বচ্ছ নীল জলের সঙ্গে পাহাড় আর চা-বাগানের মিতালি দেখে বিমোহিত হতে আসেন অনেক প্রকৃতিপ্রেমিক।
তবে অচিরেই হারিয়ে যাবে এই নদী, এমন শঙ্কা দেশের নদী বিশেষজ্ঞদের। কারণ, মেঘালয় রাজ্যে পাহাড়ি জেলা জৈন্তিয়ার জোয়াই শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে মাইনথ্রু, লামু ও উমসরিয়াং নদীর ত্রিমুখী মিলনস্থলে ‘মাইনথ্রু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের উদ্বোধন হয়। এ রকম আরও দুটি ইউনিট উদ্বোধনের অপেক্ষায়। জৈন্তিয়ার আমলারেম ব্লকের পাহাড়ি খরস্রোত আটকে ৬৩ মিটার উঁচু বাঁধ পুরোপুরি চালু হলে গোটা অঞ্চলই হয়ে পড়বে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে এই বাঁধের দূরত্ব মাত্র ৩০ কিলোমিটার। বাঁধটির অবস্থান ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল ডাউকিচ্যুতির কাছাকাছি। এই এলাকায় ভূমিকম্পের কারণেই মেঘনা নদীর অতীত খাত বদলে গেছে। আর এখন রিখটার স্কেলের মাত্র একটি সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প ধসিয়ে দিতে পারে মাইনথ্রুর বাঁধ; এমনটাই মত দিয়েছেন খোদ ভারতের পানিবিশারদরা।
মাইনথ্রু নদীর উজানে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ খনি অঞ্চল। ভারতের মূলধারা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন সাত বোন অঞ্চলের উপেক্ষিত হওয়ার ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। তাই এখানকার পাহাড়ি বনাঞ্চল কেটে, পাহাড় চিরে তৈরি হয়েছে কয়লা আর পাথর খনির প্রকল্প; কোনো রকম সমীক্ষা ছাড়াই। স্থানীয়দের বিক্ষোভ-প্রতিবাদও কানে তোলেনি ভারত সরকার। উজানের কয়লাখনির তলানি জমে মাইনথ্রু নদীতে, আর তা থেকে তৈরি হয় সালফার। ফলে পানিতে সালফিউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাতে বাঁধের যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার একটা আশঙ্কা তো রয়েছেই, সঙ্গে এই দূষিত পানির ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে মেঘালয়ের লোকালয়ে।
মাইনথ্রু বাঁধ প্রকল্প পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে কেবল মেঘালয় নয়, বাংলাদেশের মেঘনা অববাহিকায়ও ঘটবে এক দীর্ঘস্থায়ী বিপর্যয়। কৃষিজমি, মৎস্য সম্পদ, জলজ উদ্ভিদ বিপন্ন হয়ে পড়বে। ভাটির নদ-নদী, জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাবে। শুষ্ক মৌসুমে প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিজমিতে সেচ কঠিন হয়ে পড়বে। ধীরে ধীরে পুরো এলাকা মরুতে রূপ নেবে। রাতারগুলসহ সিলেটের অন্যান্য সংরক্ষিত জঙ্গলের ভেতরে নালাগুলো শুকিয়ে যাবে। আর পানির অভাবে ঊষর এলাকায় পরিণত হবে সিলেটের মিশ্র চিরসবুজ বনগুলো। ইতোমধ্যেই এই বাঁধের বিরূপ প্রভাব চোখে পড়েছে স্থানীয়দের। ঘোর বর্ষায়ও পানির সংকটে ছিল সারি নদী থেকে প্রাণ পাওয়া জলাশয়গুলো। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভারত অভিন্ন এই সীমান্ত নদীর একতরফা ব্যবহার করতে পারে না; মানবিক দিক থেকে তো নয়ই।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২-এর ১৪ অনুচ্ছেদের ঘ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, ‘চুক্তিবদ্ধ পক্ষ রাষ্ট্রের আওতাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সৃষ্ট কোনো কারণে যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রাণবৈচিত্র্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে, তবে সম্ভাব্য ক্ষতির শিকার সেই রাষ্ট্রকে তা অবহিত করতে হবে এবং ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’ আন্তর্জাতিক নদী সম্পর্কে ১৯৯৭ সালের মে মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, এর ৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহার এমন ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত হতে হবে, যেন ভৌগোলিক, পানির অস্তিত্ব ও গতিরোধ, পরিবেশ ও পরিবেশগত অন্যান্য প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য বিঘ্নিত না হয়। নদীতীরবর্তী রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে একটি রাষ্ট্রের পানি ব্যবহারের ফলে অন্য রাষ্ট্রের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া যেন সৃষ্টি না হয়। অথচ ভারত শুরু থেকেই এই বাঁধের ব্যাপারে বেপরোয়া ও নীরব। ১৯৯৮ সালে এর কাজ শুরু হলেও গত বছর উদ্বোধনের ঠিক আগে সবার দৃষ্টিতে আসে সারি নদীর বাঁধ বিষয়টি।
পরিবেশগত বিপর্যয়ের পাশাপাশি থাকছে অর্থনৈতিক বিপর্যয়; কৃষিহীন মানব বসতি, বেকার থাকা বালু, পাথর আর কয়লাশ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় ঠেকানোর কোনো উপায় থাকবে না, যদি বাংলাদেশ এখনই সোচ্চার না হয়। বলা হচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। আর ভারত সে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আগেভাগেই। নদীমাতৃক বাংলাদেশকে মরুময় রূপে না দেখতে চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।
লেখকঃ ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং পর্যটক