সুন্দরবনে বিদ্যুৎ কেন্দ্রঃ বিপন্ন পরিবেশ-প্রকৃতি-বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব
রাফী শামস
অপূর্ব সৌন্দর্য্যের আধার সুন্দরবনে বিচিত্র রকমের জীব জন্তুর বসবাস। তাদের পরস্পরের মিথোস্ক্রিয়া এবং সহযোগিতায় এখানে এক জটিল ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। দেশবাসীর কাছে সুন্দরবনকে নতুন করে উপস্থাপন করার প্রয়োজন পরে না। যে জীব বৈচিত্র্য কালের পরিবর্তনে এই সুন্দরবনে এখনো টিকে আছে তা আমাদের মতো হটকারি সিধান্ত গ্রহণকারী নাগরিকের জন্যে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ স্বরুপ। সুন্দরবন বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চল গুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে দেশীয় পিডিবি এবং ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি যৌথ চুক্তিতে সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে রামপাল নামক স্থানে ১৩২০ মেগাওয়াটের দুটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে এগিয়ে চলেছে। অথচ ভারতীয় এই কোম্পানী নিজ দেশের আইনের ফাঁক গলে পার না পেয়ে এ দেশে তাদের প্রকল্প চালু করার জন্যে বাংলাদেশ সরকার থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে গেছে। সে দেশের ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট ১৯৭২ অনুযায়ী, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোন বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জীব বৈচিত্র্যের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, বন্য প্রাণির অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। অথচ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনেকের মতে সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে।রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আমরা সবাই কম বেশি শুনেছি কিন্তু আমরা কতটুকু জানি?এটা থামানোর জন্য আমরা কি কিছু করেছি??
কিছুদিন আগে “প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চার্য” নির্বাচনের জন্য আমরা প্রায় সবাই সুন্দরবন কে ভোট দিয়েছি।সে সময় সবার যে উৎসাহ লক্ষ করা গিয়েছে এখন তার ছিটেফোটাও দেখা যাচ্ছেনা।সুন্দরবন প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চার্য হলে আমাদের গর্ব হবে কিন্তু না হলে আমাদের কোন ক্ষতি হবেনা।যদি রামপাল হয় তাহলে সুন্দরবন ই ধ্বংস হয়ে যাবে ধীরে ধীরে।তাও আমাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই!
আগে একটু দেখে আসি রামপাল হলে আমাদের ক্ষতিটা কোথায় হবে।
প্রথমত কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে একটা মারাত্মক দূষণপ্রবণ লাল ক্যাটাগরির শিল্প। এটা বনভূমি বা জনবসতির আশেপাশে থাকার কোনো নিয়ম নেই। এটা হতে হবে শিল্প অঞ্চলে। তবে কয়লা আনা নেয়ার সুবিধার্থে সাধারণত এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নদীর আশেপাশে করা হয়। সরকার বাগেরহাটের রামপালের পশুর নদীকে বেছে নিয়েছে। যার খুব কাছেই সুন্দরবন। ৩০ আগস্ট ১৯৯৯ জারি হওয়া এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বনের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে এমন কিছু করা যাবে না যাতে প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থলের ক্ষতি হতে পারে, ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট বা পরিবর্তন করতে পারে। মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনো কাজ এখানে নিষিদ্ধ।সরকার বলছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বনের ১০ কিলোমিটারের বাইরে। যে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা ওখানে অনুসন্ধান চালাতে গিয়েছিলেন, তারা ফিরে এসে বলেছিলেন এটা ৯.৫ কিলোমিটারের মধ্যে পড়ে। যেহেতু দুই পক্ষ একত্রে দাঁড়িয়ে দূরত্বটা মাপা যায়নি তাই এ প্রশ্নের সমাধান হচ্ছে না। কিন্তু কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে এ থেকে যে ছাই উৎপন্ন হবে তা উড়ে অনেক দূর পর্যন্ত যাবে। ১০ কিলোমিটারের ভেতর তো বটেই একেবারে বনের ভেতরে এই ছাই পৌঁছে যাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ছাই সুন্দরবনের মাটির গুণগত মান নষ্ট, প্রাণীদের হরমোনজাতীয় সমস্যা, প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, নদী দূষণ, মাটির উর্বরতা হ্রাস এবং উদ্ভিদের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে। যা কিনা সরকারের ওই প্রজ্ঞাপনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশেও এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দরকার। কিন্তু বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক সুন্দরবনের মতো আমাদের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বনের ভেতর এটা কিভাবে করা যায়।
এই কেন্দ্র থেকে আমরা কি কি পাব বা হারাব সেটা এক নজরে দেখে নেই-
এই প্রকল্পে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের আগ্রহ এবং লাভ দুটোই বেশি। প্রকল্পটিতে সমান অংশীদার ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি। ঠিক এই মাপেরই, ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তারা মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলার ঝিকলি-তুমরা গ্রামে করতে চেয়েছিল। কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি বিবেচনায় তারা প্রকল্পটি সেখানে করতে পারেনি। পরে যৌথভাবে করার কথা বলে তারা প্রকল্পটি সুন্দরবনের কাঁধে চাপিয়ে দেয়।যে প্রকল্প তারা নিজ দেশে করতে পারেনি সেই প্রকল্প কিভাবে বাংলাদেশে হচ্ছে?
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহনকারী জাহাজ চলাচল করার ফলে এসব জাহাজ থেকে কয়লার গুঁড়া, ভাঙা বা টুকরো কয়লা, তেল, ময়লা-আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে নদী-খাল-মাটিসহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করে ফেলবে। কয়লা লোড-আনলোড করার যন্ত্রপাতি থেকে দিনরাত ব্যাপক শব্দদূষণ হবে। রাতে জাহাজ চলাচলের সময় জাহাজের সার্চ লাইটের আলো নিশাচর প্রাণীসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সুন্দরবনের পশুপাখির জীবনচক্রের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে বনের আশেপাশে মানুষের আনাগোনা বাড়বে। সব মিলিয়ে অধিকাংশ বন্যপ্রাণী ধীরে ধীরে ভারত অংশের সুন্দরবনের দিকে সরে যাবে।
ড. আব্দুস সাত্তার মণ্ডল ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান। বিজ্ঞানীদের একটি দল নিয়ে তিনি নিজে ছুটে গেছেন সুন্দরবনে। ফিরে এসে তারা বলেছেন, এতে সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র বিনষ্ট হবে। তৈরি হবে অসংখ্য কয়লা ডিপো। শুরু হবে গাছ কাটা, বনে আগুন লাগানো, বাঘ, হরিণ, কুমির ধরা। কয়লা পোড়া সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি সুন্দরবনের জৈবিক পরিবেশ ও বায়ুমণ্ডলকে বিঘ্নিত করবে। ওই অঞ্চলের এবং আশপাশের কৃষি জমিতে উৎপাদিত কৃষিপণ্য খেলে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়বে অ্যাজমা, ফুসফুসবাহিত নানা রোগ, এমনকি ক্যান্সারের সম্ভাবনাও রয়েছে। সুন্দরবনের ঐতিহ্য মূল্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। সবশেষে তারা মূল্যায়ন টেনেছেন, বনটা ধ্বংসই হয়ে যাবে।
এই প্রকল্পে প্রতি ঘণ্টায় ১৪৪ কিউসেক পানি লাগবে। ১৪৪ কিউসেক পানি তোলার জন্য রামপালে ৭২টি গভীর নলকূপ বসাতে হবে। এতে অল্প সময়ের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকার ভূ-উপরিভাগ মরুভূমিতে পরিণত হবে। এতে করে সরাসরি আক্রান্ত হবে সুন্দরবন। উজাড় হবে সুন্দরবনের গাছপালা। এছাড়া প্লান্টে ব্যবহৃত গরম পানি কনডেনসারের মাধ্যমে কিছুটা ঠাণ্ডা করে ছেড়ে দেয়া হবে নদীতে। এ ধরনের উষ্ণ পানি পুরো পশুর নদীর মাছ ও অন্যান্য জলজীবকে ধ্বংস করবে।
ভয়ংকর ব্যাপার হলো, একদিকে বলা হয়েছে এই বিষাক্ত ছাই পরিবেশে নির্গত হলে ব্যাপক দূষণ হবে অন্যদিকে এই ছাই দিয়েই প্রকল্পের মোট ১৮৩৪ একর জমির মধ্যে ১৪১৪ একর জমি ভরাট করার পরিকল্পনা করা হয়েছে! এই বর্জ্য ছাই- এর বিষাক্ত ভারী ধাতু নিশ্চিত ভাবেই বৃষ্টির পানির সাথে মিশে, চুইয়ে প্রকল্প এলাকার মাটি ও মাটির নীচের পানির স্তর দূষিত করবে যার প্রভাব শুধু প্রকল্প এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।
চুক্তির সমস্যা হচ্ছে, প্রকল্পের অর্থ আসবে বিদেশি ঋণ থেকে ৭০ ভাগ, ভারত ১৫ ভাগ আর আমরা ১৫ ভাগ। আর ওই বিদেশি ৭০ ভাগ ঋণের সুদ টানা এবং ঋণ পরিশোধ করার দায় দায়িত্বও আমাদের। অর্থাৎ ভারতের বিনিয়োগ মাত্র ১৫ ভাগ। কিন্তু তারা মালিকানা পাচ্ছে ৫০ ভাগ। পুরো অর্ধেক। তাছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুরো ক্ষয়ক্ষতিটা যাবে আমাদের ওপর দিয়ে। চুক্তি অনুযায়ী কয়লা আমদানির দায়িত্বও আমাদের কাঁধে। কয়লা না এলে কিছুদিন উৎপাদন বন্ধ থাকলে, ভারতকে ক্ষতিপূরণ দিতে হতে পারে।
এবার আসুন মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়। ১৮৩০ একরধানী জমি অধিগ্রহণের ফলে ৮০০০ পরিবার উচ্ছেদ হয়ে যাবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মসংস্থান হতে পারে সর্বোচ্চ ৬০০ জনের, ফলে উদ্বাস্তু এবং কর্মহীন হয়ে যাবে প্রায় ৭৫০০ পরিবার। শুধু তাই নয় আমরা প্রতি বছর হারাবো কয়েক কোটি টাকার কৃষিজ উৎপাদন।
এসবের মধ্যেই আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন অভিমুখে লং মার্চের ডাক দিয়েছে তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। সরকার যদি বনের মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার চিন্তা থেকে এর মধ্যে না সরে আসে তাহলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠবে। জাতীয় সম্পদ ইস্যুতে তরুণদের সচেতনতা এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। সরকার সেখানে বিদেশি বন্ধুর সঙ্গী হয়ে বন দখলের লড়াইয়ে মেতে উঠলে তা হয়ত আরেক ফুলবাড়ীর জন্ম দেবে। সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন থেকে বের করে আনার প্রজ্ঞা দেখাতে পারে কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
আমাদের এই মুহূর্তে রামপাল নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।ফেসবুক ব্লগের সাহায্যে সবাইকে বিষয়টি জানাতে হবে।বুঝাতে হবে যে সুন্দরবন আমাদের মা,মা যেমন সন্তান কে সব বিপদ থেকে আগলে রাখে সুন্দরবন তেমনি আমাদের সব রকম দুর্যোগ থেকে আগলে রাখে।এই মা কে ধ্বংস করে আমরা বিদ্যুৎ চাইনা।আর বিদ্যুত উদপাদনের জন্য অন্য অনেক উপায় আছে,কিন্তু সুন্দরবন কে কিছুতেই ধ্বংস হতে দেয়া যাবেনা।
সরকার বলছে এতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্ষয়ক্ষতি কমানো হবে।যদি তাই হয় তাহলে সেই প্রযুক্তি কি আর সেগুলো কিভাবে ক্ষতি রোধ করবে তা বিস্তারিত বলা উচিত।আর প্রধান বিরোধীদল এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। তারা এ প্রকল্পের বিপক্ষে কখনোই কোনো মতামত দেয়নি। পান থেকে চুন খসলেই সরকারের সমালোচনায় মেতে উঠলেও সুন্দরবন ধ্বংস প্রশ্নে তারা সরকারের পাশেই দাঁড়িয়েছে।যদি কোন আন্দোলন হয়ও তখন এই বিএনপি নিছক আন্দোলনের সুবিধা নেয়ার জন্য তথাকথিত সমর্থন জানাবে।
সে যাই করুক,রাজনীতিবিদরা তাদের নিজেদের কথা ভাবলেও আমাদের সাধারণ মানুষের তাতে কিছু যাবে আসবে না।আমরা শুধু দেখতে চাই রামপালে কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র হবেনা…