"স্বাস্থ্য রক্ষায় খাদ্য আইন দ্রুত কার্যকর কর" – পবা'র মানববন্ধন
খাদ্যের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইন এর বাস্তবায়ন না থাকায় খাদ্যের মাধ্যমে নীরব গণহত্যা চলছেই। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্য আইন দ্রুত কার্যকর করতে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ১২ জুলাই ২০১৩, শুক্রবার, সকাল ১১ টায় হাইকোর্ট মাজার গেইটের সামনে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও আইনের পাঠশালার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধন থেকে উক্ত দাবী জানানো হয়।
মানববন্ধন থেকে বলা হয়-প্রতিটি ভোক্তার নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আমরা এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত। শিশু খাদ্য থেকে শুরু করে ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংসসহ প্রায় সব ধরনের খাবারে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানো হয়। বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম, পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ও ভোক্তা অধিকার কর্মীদের বক্তব্যে এবং সাম্প্র্রতিক সময়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)-এর ঢাকার বাজারে মৌসুমী ফলে ফরমালিন পরীক্ষার ফলাফলে বিষাক্ত খাদ্যের ব্যাপকতার যে চিত্র ফুটে ওঠে, তা রীতিমত আতঙ্কজনক।
রমজানে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর রেল ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, মোটর যান, নৌ যান ও কলকারখানার পোড়া তেল ও মবিল মিশ্রিত তেল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ইফতার সামগ্রী ভাজা হয়। এছাড়াও একই তেল বার বার ব্যবহার করা হয়। মিষ্টিজাতীয় খাদ্য দ্রব্যে কাপড়ের রং এবং কলা, পেপেসহ বিভিন্ন ফল পাকাতে রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয়। এমনকি মুড়ি ও চিড়াতেও রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয়। এসব খাবার ক্যান্সার, কিডনী ও লিভারের জটিল রোগ সৃষ্টিসহ গর্ভস্থ শিশু প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রাসায়নিক রং ও বিভিন্ন উপাদান মিশিয়ে ভোজ্য তেল তৈরী করা হয়। বিষাক্ত রং ব্যবহার করে সাদা ডিম লাল করা হয়। এছাড়াও লাল শাকের মধ্যে লাল রং গ্রহণে অল্প বয়সের শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে, মাথা ধরা ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। রমজানে বিশেষ করে ঈদে সেমাই এর ব্যাপক চাহিদা থাকে বিধায় নিম্নমানের দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই তৈরী করা হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
বিশুদ্ধ, দূষণমুক্ত ও মানসম্মত খাদ্য নিশ্চিতকরণ এবং ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণে বেশ কয়েকটি আইন প্রচলিত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে – বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ যা বর্তমানে বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য (সংশোধিত) আইন, ২০০৫, বিএসটিআই অডিনেন্স, ১৯৮৫ যা বর্তমানে বিএসটিআই (সংশোধিত) আইন, ২০০৩, মোবাইল কোর্ট অডিনেন্স ২০০৯, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৫৬, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫।
বাংলাদেশ বিশুদ্ধ খাদ্য আইনে মানব-স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, কীটনাশক (ডিডিটি, পিসিবি তেল) বা বিষাক্ত রং খাদ্যে ব্যবহার এবং ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, কীটনাশক (ডিডিটি, পিসিবি তেল) বা বিষাক্ত রং মিশানো খাদ্য বিক্রি নিষিদ্ধ। প্রতিটি জেলা এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় এক বা একাধিক বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত স্থাপনের বিধান রয়েছে।
বিএসটিআই আইনে খাদ্যের বিদ্যমান মান বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সেকেলে, বৈশিষ্ট্যমূলক গুণ বা ধর্ম নির্ভর এবং উপর্যুপরি এর অধিকাংশ সাধারণ খাদ্য অন্তর্ভুক্ত নয়। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে খাদ্য পণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণের দন্ড – মানুষের জীবন বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোন দ্রব্য, কোন খাদ্য পণ্যের সহিত যাহার মিশ্রণ কোন আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হইয়াছে, কোন ব্যক্তি উক্তরূপ দ্রব্য কোন খাদ্য পণ্যের সহিত মিশ্রিত করিলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন বৎসর কারাদন্ড, বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫- আইনের বিধান সাপেক্ষে, পরিবেশ সংরক্ষণ, পরিবেশগত মান উন্নয়ন এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রশমনের উদ্দেশ্যে মহা-পরিচালক তৎকর্তৃক সমীচীন ও প্রয়োজনীয় বলিয়া বিবেচিত সকল কার্যক্রম গ্রহণ করিতে পারিবেন এবং এই আইনের অধীন তাহার দায়িত্ব সম্পাদনের উদ্দেশ্যে যে কোন ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় লিখিত নির্দেশ দিতে পারিবেন।
বিষাক্ত খাদ্যের ভয়াবহতা বিবেচনায় সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে এবং ২ জুলাই ২০১৩ মন্ত্রিসভা নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ (খসড়া) অনুমোদন করেছে। এ আইন বাস্তবায়ন করবে খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং বাস্তবায়নের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। আইনে ১৯ ধরনের অপরাধের শাস্তির জন্য বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড ও বিভিন্ন অংকের অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে এবং প্রথমবার একটি অপরাধ সংঘটনের জন্য কোন ব্যক্তি অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদন্ড, বা অনধিক দশ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন। পুনরায় একই অপরাধ সংঘটনের জন্য কোন ব্যক্তি অনূর্ধ্ব চৌদ্দ বছরের কারাদন্ড, বা অনধিক বিশ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন। ইহা ছাড়াও উক্ত দোকান, কারখানা ও উহার যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করা যাইবে। উক্ত আইনসমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরী।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন পবার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আসলাম খান, সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহান, আইনের পাঠশালার সভাপতি সুব্রত দাস খোকন, বাংলাদেশ পীস মুভমেন্টের সভাপতি প্রফেসর কামাল আতাউর রহমান, বিসিএইচআরডির নির্বাহী পরিচালক মো: মাহবুবুল হক, পবার নির্বাহী সদস্য শামীম খান টিটো, মিজান শরীফ খোকা, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, গ্রীণমাইন্ড সোসাইটির সভাপতি আমির হাসান, দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংসদের সভাপতি মো: মুসা, আইনের পাঠশালার সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান অনিক, সংবিধান বিষয়ক সম্পাদক মো: নওশাদ পারভেজ, প্রচার সম্পাদক নেওয়াজ শরীফ প্রমুখ।
মানববন্ধন থেকে নিন্মোক্ত দাবী জানানো হয়-
১. স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাদ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল আইনসমূহ দ্রুত কার্যকর করা
২. খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যাদি মিশানোর সাথে জড়িত ও রাসায়নিক দ্রব্যাদিযুক্ত খাদ্য বিক্রয়কারীদের বিরুদ্ধে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট, ১৯৭৪ এর ২৫-গ ধারা প্রয়োগ করা। এই আইনের ২৫-গ ধারায় খাদ্যে ভেজাল দেয়ার জন্য কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ বা ভেজাল খাবার বিক্রয়ের জন্য মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে।
৩. জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে খাদ্যে বিষ বা ভেজাল রোধে কোন রকম বৈষম্য বা রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই আইন প্রয়োগে সরকারের প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. ভেজাল বিরোধী টিম নিয়মিতভাবে খেজুরসহ অন্যান্য ফল, সকল খাদ্য মজুদকারী গুদাম/কারখানা /মোকাম বিশেষ করে সেমাই, মুড়ি, চিড়া কারখানা পরিদর্শন করা এবং জড়িত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে বিদ্যমান আইনের আওতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
৫. খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ এবং পরিদর্শন ও এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনায় সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের সাধন।
৬. পণ্য আমদানি পর্যায়ে এনবিআর কর্তৃক ফরমালিনসহ অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদি পরীক্ষা করা এবং ফরমালিন ব্যবহার ও আমদানির মধ্যে সমন্বয় সাধন।
৭. গণমাধ্যমে প্রচার- প্রচারণায় ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের ফরমালিন ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যাদির বিষয়ে সচেতন করা।
৮. ভেজালবিরোধী বা খাদ্যে রাসায়নিকের ব্যবহারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম পরিচালনাকারী অন্য সরকারী সংস্থা ও পরীক্ষাগারগুলোর সাথে নিরাপদ খাদ্য আইন-এ উল্লেখিত কর্তৃপক্ষের কাজের সমন্বয়ের বিষয়টি আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।