হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, শ্রীমঙ্গল:
ধীরস্থির ও গম্ভীর স্বভাবের সরীসৃপ প্রাণীটির নাম কচ্ছপ। এ জন্যই হয়তোবা খরগোশ আর কচ্ছপের গল্পটি ছেলেবেলায় বইয়ের পাতায় জুড়ে দেওয়া হয়েছিল কর্তব্যে সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়টিকে মাথায় রেখে। পানি কিংবা ডাঙ্গায় উভয় স্থানেই স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে কচ্ছপ। এক সময় এরা ঝিল-বিল, নদী-নালা, পুকুর-ডোবা কিংবা সমুদ্র-উপকূল কিংবা উঁচু-নিচু পাহাড়ি বনভূমি পায়ের শান্ত পরশে মাতিয়ে রাখত। সেই দৃশ্য আজ অতীত! আবাসস্থল ধ্বংস আর মানুষের লোভ-লালসার শিকার হয়ে নীরবে হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় কচ্ছপের বিভিন্ন প্রজাতি। এ ছাড়াও জলবায়ুর পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, কীটনাশকের ব্যবহার, অতি বেগুনি রশ্মির বিকিরণসহ নানা কারণে পৃথিবীজুড়ে উভচর প্রাণীরা রয়েছে আজ মারাত্মক হুমকির মধ্যে। আশঙ্কাজনকভাবে বিপন্ন হয়ে যাওয়া এই প্রজাতির কচ্ছপের নাম ‘হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ’ কেউ কেউ আবার হলুদ পাহাড়ি কাছিমও বলে থাকে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ বা আইইউসিএন থেকেও লাল তালিকাভুক্ত এ প্রাণীটি। এরা ডাঙ্গায় চলাফেরা করে বলে বনভূমি বা চা বাগান এলাকার মানুষেরা ভ্রান্ত ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদের ধরে খেয়ে ফেলে। তবে আশার কথা হচ্ছে, গাজীপুরের কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্র এই হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়েছে।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, ‘হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপের ইংরেজি নাম Elongated tortoiseএবং বৈজ্ঞানিক নাম Imdptestido elongata। এরা মূলত ডাঙ্গার কচ্ছপ। অন্য যেসব কচ্ছপ আমরা পানিতে দেখি তারা ডাঙ্গায় বেশি সময় থাকে না। কিন্তু এ কচ্ছপটি ডাঙাতেই বেশি সময় থাকে। এর ফলে এ প্রাণীটি খুব সহজেই মানুষের নজরে আসে। পানির কচ্ছপগুলো তো সব সময় দেখা যায় না। ডাঙায় থাকে বলেই এটিকে মানুষ প্রায়ই মাংসের জন্য হত্যা করে। আর এভাবেই এদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বৃহত্তর সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মিশ্র চিরসবুজ বনেই এদের বসবাস। এরা আকারে ৩৩ সেন্টিমিটার এবং ওজনে প্রায় তিন কেজি হয়ে থাকে। এরা মূলত নিরামিষভোজী। এরা বিভিন্ন পাতা, সবুজ কচি ঘাস, ফুল, ফল ও ব্যাঙের ছাতা অর্থাৎ ফাঙ্গাস খায়।’ তিনি আরো বলেন, “আমাদের দেশে প্রায় ২৯ প্রজাতির কচ্ছপের বিচরণ রয়েছে। যাদের বেশির ভাগই এখন বিপন্ন। এর মধ্যে হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপও আজ বিলুপ্তির পথে। বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীজুড়েও মহাবিপন্ন তালিকাভুক্ত একটি প্রাণী হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ‘লাল তালিকাভুক্ত’ প্রাণী হিসেবে এদের চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ যারা অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে।”
বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রজাতির কচ্ছপের প্রজনন রক্ষায় কাজ করছে সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন নেচারাল রিসোর্সেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (ক্যারিনাম) প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী প্রধান ড. এস এম এ রশীদ বলেন, ‘বন বিভাগের সঙ্গে যৌথ উদ্যেগে আমরা গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে ইতিমধ্যে তিন প্রজাতির দেশীয় কচ্ছপের প্রজনন রক্ষায় কাজ করে চলেছি। এগুলো হলো_মুখপড়া কচ্ছপ, বড় পাহাড়ি কচ্ছপ এবং কালী কচ্ছপ। আবাসস্থল নষ্ট এবং ধরে খেয়ে ফেলার ফলে কচ্ছপের সংখ্যা এখন বিলুপ্তির পথে। তবে আমরা হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ সংরক্ষণেও উদ্যোগ নিয়েছি। এর প্রজনন রক্ষায় আমরা অচিরেই কাজ শুরু করব।’
সরীসৃপ গবেষক শাহরীয়ার সিজার রহমান বলেন, ‘হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ খুবই বিরল প্রজাতির প্রাণী। লাউয়াছড়ায় গবেষণা করতে এসে এর একটি ছানা পেয়ে যাই আমি। তখনই এ ছবিটি তুলি।’ এ কচ্ছপটি সম্পর্কে শাহরীয়ার আরো বলেন, ‘এদের শরীরজুড়ে হলুদ রঙের মধ্যে কালো কালো ছাপ রয়েছে। এরা ঘন বন, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, ঝোপঝাড় ও ছড়ার আশপাশে থাকে। এরা সাধারণত একাই বিচরণ করে। প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী ও পুরুষ একত্রে থাকে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষ ও স্ত্রী হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপের মাথা এবং মুখের আশপাশে লালচে রং ফুটে ওঠে। মে থেকে অক্টোরর এদের প্রজননকাল। এরা সাধারণত বর্ষা মৌসুমে দুই থেকে ৯টি ডিম পাড়ে। এরা মুরগির মতো ডিমে তা দেয় না। মাটিতে গর্ত করে ডিমগুলো ঢেকে রেখে চলে আসে। তিন থেকে সাড়ে পাঁচ মাস পর ছানা বের হয়। বাচ্চাগুলো পাঁচ থেকে সাত সেন্টিমিটার হয়। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এদের পাওয়া যায়।
লেখক: দৈনিক কালের কণ্ঠের শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি।
লেখাটি প্রকাশের তারিখ ও গণমাধ্যমের নাম : ২৭ এপ্রিল ২০১৩, দৈনিক কালের কণ্ঠ