স্মরণে নাগাসাকি…মানবতার বিপর্যয়ের সাত দশক
সিফাত তাহজিবা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আগস্ট মাসের ৬ তারিখে হিরোশিমাতে পারমানবিক বোমার বিস্ফোরনের ঠিক ২ দিন পর জাপানের বন্দর নগরী নাগাসাকিতে আমেরিকানরা ঘটালো দ্বিতীয় পারমানবিক বিস্ফোরন!
জাপানিদের জন্য নাগাসাকি ছিল সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ন শহর কেননা সেখানে সামরিক জাহাজ নির্মাণ কারখানা এবং যুদ্ধে নাগাসাকিকে সামরিক বন্দর হিসেবে ব্যবহার করা হত। দ্বিতীয় পারমানবিক বোমা হামলার জন্য আমেরিকানরা আবার বেছে নিল আরেকটি বি-২৯ বোমারু বিমান,যার নাম দেওয়া হয়েছিল-‘ব্কস্কার’।
কিন্তু, এই দ্বিতীয় পারমানবিক বোমা আক্রমণের লক্ষ্যস্থল ‘নাগাসাকি’ ছিল না, ছিল জাপানেরই আরেকটি শহর ‘কোকুরা’!
১৯৪৫ সালের এই দিনে,৯ আগস্টে, ‘বকস্কার’ বিমানের ক্রু’গণ তিনিয়ান দ্বীপপুঞ্জে জমায়েত হয় এবং মাত্র ৩ ঘন্টা ৪০ মিনিটে পারমানবিক বোমা নিয়ে ‘কোকুরার’র উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলে। এবার মিশনের ফ্লাইট কমান্ডার ছিলেন মেজর সোয়েনি।
হিরোশিমা ধংস্বকারী ‘লিটল বয়’ পারমানবিক বোমাটির থেকে এবারের পারমানবিক বোমাটি ছিল অনেকটাই ভিন্ন। এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ফ্যাট ম্যান’!
বোমাটি বিস্ফোরনের পদ্ধতি ছিল ‘Implosion’। বোমাটির ভিতরে বিস্ফোরকগুলোর ৬৪টি বৃত্ত ছিল যা প্লুটোনিয়ামের টুকরোগুলোকে একত্রে টেনে নিয়ে খুবই ক্ষুদ্রকার অংশে পরিণত করে শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটায়। ১০ ফুট 8 ইঞ্চি লম্বা ‘ফ্যাট ম্যান’র ওজন ছিল ১০,০০০ পাউন্ড! এর বিস্ফোরণের ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি প্রায় ২০,০০০ টন বিস্ফোরকের সমান!’ফ্যাট ম্যান’কে নিয়ে আমেরিকান বোমারু বিমানটি ‘কোকুরা’ শহরের আকাশ সীমায় এসে পৌঁছুলে, ফ্লাইট কমান্ডার দেখলেন ‘কোকুরা’ শহরের উপরে ঘন মেঘ! মেঘের জন্য কোনভাবেই লক্ষ্য ঠিক করা যাচ্ছে না। বোমারু বিমানটি নিয়ে ফ্লাইট কমান্ডার শহরটির উপর তিনবার চক্কর দিলেন কিন্তু ঘন মেঘের কারণে কোন জায়গাতেই ফাকা পেলেন না এছাড়া বিমানটি উড্ডোয়নের সময় থেকেই জ্বালানী নিয়ে সমস্যা দেখা দিচ্ছিল এবং সে সময় তিনি লক্ষ্য করেন খুবই স্বল্প জ্বালানী আছে যেটি নিয়েই ফ্লাইট কমান্ডার মনস্থির করে ফেললেন ‘কোকুরা’ কাছেই ‘নাগাসাকি’ বন্দরে বোমাটি ফেলবেন। বোমাটি ফেলে যেটুকু জ্বালানী থাকবে তা দিয়ে আর তিনিয়ান দ্বীপে ফেরত আসা সম্ভব হবে না অবতরণ করতে হবে ‘ওকিনাওয়া’ দ্বীপে! অল্প সময়েই হিসাব্ কষে ফ্লাইট কমান্ডার ‘বকস্কার’কে নিয়ে রওনা হলেন’নাফাসাকি’র উদ্দেশ্যে!
সকাল ১১টায় প্রায় ২৮,৯০০ ফুট উচ্চতা থেকে ফ্যাট ম্যানকে নাগাসাকির উপর ফেলা হল। নাগাসাকিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে বেশিবার বিমান হামলা চালিয়েছে আমেরিকানরা। তাই আকাশে আমেরিকান বিমানের উপস্থিতি রাডারে ধরা পড়া মাত্রই শহরের মানুষদের সতর্ক করতে এবং সামরিক বাহিনীকে অবস্থান নেওয়ার জন্য ‘সাইরেন’ বাজানো হত।
নাগাসাকি ছিল বোমা হামলা থেকে বাচার জন্য প্রস্তুত একটি শহর এর চারপাশের পাহাড়গুলোর ভিতর সুড়ংগ করা ছিল যার ভিতর মানুষজন সাইরেনের আওয়াজ পেয়ে বিমান হামলা থেকে বাচতে ছুটে যেত। এই ‘ফ্যাট ম্যান’ পারমানবিক বোমাটি ‘লিটল বয়’ বোমা থেকে অনেক বেশি কার্যকর ছিল,এর তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ছিল বহু গুণ বেশি!! কিন্তু নাগাসাকির প্রাকৃতিক অবস্থান আর পাহাড়গুলো এর নির্মমতা কিছুটা হলেও কমাতে পেরেছিল। পাহাড়ে ঘেরা নাগাসাকির একপ্রান্ত প্রাকৃতিক সুরক্ষা পেয়েছিল কিন্তু অন্যপ্রান্তে (শহরের ৩০ শতাংশ) তেজস্ক্রিয় বোমাটি ব্যাপক ক্ষতি করতে সক্ষম হয়েছিল। হিরোশিমার মত নাগাসাকিতে রেলওয়ে বিঘ্নিত হয়নি এবং বিস্ফোরণের আগুনের শিখাও হার মেনেছে নাগাসাকির প্রাকৃতিক দেওয়ালের কাছে শুধু তাই না নাগাসাকির ভিতরে বেশ অনেক অংশজুড়ে আছে নদীপথ যেগুলোর কারনে বিস্ফোরণটি ভয়াবহ রূপ নিতে পারেনি! ইতিহাসে শিক্ষনীয় অনেককিছুই আছে! পরিবেশ আমাদের কতটা আগলে রাখে তা কি আমরা এখনও অনুভব করতে পারিনি? পাহাড়-নদী শুধুমাত্র সুন্দরের প্রতীক নয় আমাদের রক্ষকও বটে!
হিরোশিমার তুলনায় নাগসাকিতে বোমা হামলায় আহত-নিহত মানুষের সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু, শহরের অধিকাংশ অধিবাসীরা বোমার তেজস্ক্রিয়তার আঘাত নিয়ে বেচে ছিল,শারীরিক ও মানসিকভাবে নাগাসাকির মানুষজন বিপর্যস্ত হয় পড়ে। আমেরিকানরা ক্রমাগত জাপানের উপর হামলা চালিয়ে আসছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেনো জাপান আত্নসমর্পণ করে!
অবশেষে আগস্টের ১৪ তারিখে জাপান মিত্র শক্তির কাছে আত্নসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।