'আফ্রিকান ক্যাটস'- ওয়াল্ট ডিজনির বিখ্যাত তথ্যচিত্র!

সিরাজাম মুনির শ্রাবণ

প্রাণী, প্রকৃতি, পরিবেশের উপর তথ্যচিত্র দেখতে কার না ভাল লাগে? তেমনই একটি অসাধারণ তথ্যচিত্র ‘আফ্রিকান ক্যাটস’ (আফ্রিকার বিড়াল !) দেখে ফেললাম। ২০১১ সালের বিশ্ব ধরিত্রী দিবসকে উপলক্ষ্য করে  ওয়াল্ট ডিজনি স্টুডিও এই তথ্যচিত্রটি মুক্তি দেয়। এসব প্রকৃতি সংশ্লিষ্ট তথ্যচিত্র তৈরির জন্য ডিজনি্র স্বতন্ত্র একটি শাখা আছে। Disneynature নামে এরই আওতায় ওশ্যান, আর্থ, শিম্পাঞ্জি, বিয়ার নামের ডকু ফিল্মগুলো মুক্তি পেয়েছে। বলা বাহুল্য প্রত্যেকটিই অসাধারণ। বরাবরের মতো ‘আফ্রিকান ক্যাটস’ ও অসাধারণ হয়েছে।

10922462-422328297916533-1564035

‘ক্যাট’ বলতে এখানে শুধু বিড়ালকে বুঝানো হয়নি। বিড়াল জাতীয় প্রাণী বাঘ ও সিংহকে বুঝানো হয়েছে। মূলত তথ্যচিত্রটি বাঘ ও সিংহের জীবনধারণ, চলাফেরা, যুদ্ধ, সংগ্রাম ইত্যাদি নিয়ে তৈরি করা হয়েছে। একদল বাঘ শাবক আর একদল সিংহ শাবকের ছোটবেলাকার গল্প এবং তার পটভূমিতে আশেপাশের সকল ঘটনা চরিত্রকেও চিত্রায়িত করা হয়েছে। আঁকারে ছোট (দেড় ঘণ্টা) হলেও এর পটভূমি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি পরিমাণ বিস্তৃত।

10483086-422329954583034-1607921
চিত্র: আঁকাবাঁকা নদী দিয়ে একটি এলাকা দুই ভাগে বিভক্ত। দুই ভাগে দুই রাজ্য, দুই রাজার শাসন।

কেনিয়ার এক সংরক্ষিত এলাকায় এই তথ্যিচিত্রের পটভূমি। আঁকাবাঁকা একটি ছোট নদী দ্বারা একটি এলাকা দুই ভাগে বিভক্ত। দুই ভাগে দুটি আলাদা আলাদা রাজ্য। এতে আলোকপাত করা হয় একটি সিংহ শাবককে। তার নাম রাখা হয় ‘মারা’, আর মারা’র মায়ের নাম ‘লেইলা’। এরা থাকে নদীর এক পাড়ে। অন্যদিকে আছে আরেক বাঘিনী মা ‘সিতা’ ও তার পাঁচটি নব জন্ম নেয়া বাচ্চা। মারা ও লেইলার নেতা হিসেবে আছে আরেক সিংহ ‘ফ্যাং’ যে তার সাহসিকতা দিয়ে অন্য প্রাণীদের হুমকি থেকে নিজের অনুগত প্রাণীদের রক্ষা করে। ফ্যাং এর একটি দাঁত থাকে ভাঙ্গা, যেটা তরুণ বয়সে যুদ্ধ করার সময় ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাদের সমাজে এই ভাঙ্গা দাঁতের অধিকারীকে সাহস এবং শক্তি সামর্থ্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। সিতার এলাকার মাঝেও সরদার আছে কালি নামের এক বড় রকমের সিংহ। এই দুই এলাকার মাঝে, দুই সর্দারের যুদ্ধ। কাহিনীর এক পর্যায়ে দেখা যায় দুই দলনেতার একজন অন্যজনকে পরাজিত করে ফেলে এবং পরাজিত জন এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। এতে করে তার ছায়ায় থাকা সকল প্রাণী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। যেকোনো সময়ই তাদের উপর হতে পারে আক্রমণ। খাবার দাবারে নেই কোনো স্বাধীনতা। ইচ্ছে করলেই একটা শিকার ধরে খেতে পারবে না। এই বনে টিকে থাকাই মূল কথা। টিকে থাকতে গিয়ে নানান রকমের অ্যাডভেঞ্চারের দেখা পাওয়া যায়। মূলত তাদের জীবনের সমস্তটাই তো অ্যাডভেঞ্চারে ভরা।

এখানে বাঘ সিংহের কোমল দিকগুলো দারুণভাবে ফুঁটে উঠেছে। আমরা বাঘ-সিংহকে শিকারি, হিংস্র বলেই চিনি। তাঁরা চোখের পলকেই হরিণ, গরু সহ অন্যান্য নিরীহ প্রাণীদের মেরে ফেলে। এই বলে আমাদের মানসিকতা তাদেরকে জন্তু ক্যাটাগরিতেই সীমাবদ্ধ করে রাখে। মূলত খাবারের জন্য কত শত প্রাণীকে তো আমরাও মারি। তাঁরাও তাঁদের জীবনের তাগিদে অন্য প্রাণিকে মেরে থাকে। শুধু পদ্ধতিটা আলাদা, আমরা মারি দা-বটি-ছুরি দিয়ে আর তাঁরা মারে দাঁত-নখ দিয়ে।

african-cats-fast-sita
চিত্র: শিকারি চিতা ক্ষিপ্র গতিতে ছুটছে শিকারের দিকে।

এই মুভিতে দেখা যায় বাঘ ও সিংহের মমতাময় অন্য এক পরিচয়। এক মা কীভাবে তার সন্তানদের টিকে থাকার জন্য সকল কিছু শিখিয়ে দিবেন তার আপ্রাণ চেষ্টার চিত্র। কীভাবে এক মা সকল বিপদ থেকে তার সন্তানদের রক্ষা করে রাখে তার চিত্র। কিন্তু সন্তান তো একাধিক আর মা তো একজন। তার উপর দিনের একটা সময় তো তাকে ঘুমিয়ে কাটাতে হয়। তখন কি হয় যখন মা ঘুমিয়ে থাকে? বিপদ পদে পদে। ঘুমের সময় মায়ের বুক খালি করে নেয় হায়েনার দল। জলে ডাঙ্গায় সবখানেই বিপদ। কোনো কাজে নদীর ওপাড়ে যেতে হলে,সেখানেও আছে কুমিরের ভয়। কিন্তু তবুও জীবনের তাগিদে কুমিরে ভরা নদী পাড়ি দিতে হয়।

10919020-422329217916441-4317509
চিত্র: জলে আছে কুমিরের ভয়।

শিকারেও থাকে ভয়। প্রত্যেকটা শিকারেই ঝুঁকি থাকে। লেইলার ক্ষিপ্র গতিতে জেব্রা শিকার করার সময় জেব্রা পেছন দিক হতে তাকে লাথি দেয়। এটা জেব্রাদের জীবন রক্ষা করার একটা কৌশল। শিকারি যখন পেছন দিক থেকে শিকার করতে আসবে সে পালানোর পাশাপাশি পেছন দিক থেকেও নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। এই একটা লাথিতেই পাল্টে যায় লেইলার পুরো জীবন। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাটতে হয় তাকে আর জোরে জোরে দৌড়ানো সম্ভব হয় না। বাঘ বা সিংহরা যদি জোরে জোরে দৌড়াতে না পারে তাহলে তাঁরা শিকার করতে পারবে না। ফলাফল ধুকে ধুকে মরা।

এক এলাকায় সবসময় পর্যাপ্ত খাবার থাকে না, তাদেরকে খাবার অনুসারে এলাকা পাল্টাতে হয়। এলাকা পাল্টানোর সময় পুরো দল একসাথে যায়। লেইলার ছোট মেয়ে এখনো নিজের নিরাপত্তা নিজে করতে পারবে না, তাই দলের সাথে থাকা দরকার। আবার সে জখম হওয়া পা নিয়ে দলের সাথে তাল মিলিয়ে যেতেও পারবে না। এমন অবস্থায় কি করবে একজন মা? সন্তানকে যেতে দিয়ে একা হয়ে যাবে না সন্তানকে নিজের কাছে রেখে দিবে? এক চরম মানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় এই সময়। একজন মা কী করে সন্তানের জন্য আর একজন সন্তান কী করে মায়ের জন্য ?

লেইলা যখন সন্তানের সুরক্ষার জন্য তাকে ত্যাগ করে একা একা চলে যায় তখন বেদনাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শিকারে অক্ষম লেইলা যখন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায় তখন আশ্চর্য লাগে এই দেখে, ভালোবাসা কেমন হতে পারে! আর সেই মুহূর্তে এমন একটি আবহ সঙ্গীত দেয়া হয় তথ্যচিত্রটিতে যে একেবারে হৃদয়ে গিয়ে ছোঁয়। ছোটখাটো কিছু সুর, কিছু শব্দ একটা ভিডিওকে অপূর্ব করে তোলে। সুর দিয়ে যেন সমস্ত আবেগটাকে বের করে আনে। এই সুরের মাধ্যমেই যেন বোঝানো হয় লেইলা তার সন্তানকে ছেঁড়ে দূরে সরে আসে সন্তানের চোখের আড়ালে ভাল একটা জায়গায় যেন তার মরণ হয়। সন্তানের সামনে সন্তানের দুঃখের কারণ হয়ে সে মরতে চায় না। একটা ছবি কিংবা তথ্যচিত্রকে প্রিয় তালিকায় স্থান করাতে এই সকল বিষয়গুলো অনেক ভূমিকা পালন করে। ডিজনির এই তথ্যচিত্রটিতে সুরের ব্যবহার ছিল একদম যুতসই। শুধু একটি সমস্যা ,একই সুর দুটি বা তিনটি ভিন্নধর্মী জায়গায় ব্যবহার করেছে। সমধর্মী স্থানে ব্যবহার করলে হয়তো আরো মাধুর্যপূর্ণ হতো।

10929123-422331847916178-2867290
চিত্রঃ লেইলা ও তার সন্তান মারা।

এভাবেই একটু একটু করে শাবকেরা বেড়ে ওঠলে তথ্যচিত্রটির সমাপ্ত হয়। এটি মুক্তি পাওয়ার প্রথম দিনেই ৩.৩ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করে নেয়। এটি প্রথম দিনেই সেরা উপার্জনের তালিকায় তৃতীয়! এর আগের স্থান দখল করে রেখেছে ডিজনিরই আরেক তথ্যচিত্র ‘আর্থ’। ‘আফ্রিকান ক্যাটস’ মুক্তি পাবার আগেই অগ্রিম টিকেট বিক্রি হয় ১.৭ মিলিয়ন কপি।

সবশেষে ‘আফ্রিকান ক্যাটস’- তথ্যচিত্র থেকে কতগুলো স্ক্রিনশট তুলে দিচ্ছি।

10362622-422336317915731-8995150

10365337-422337474582282-2107907

10887675-422338371248859-5822798

10924666-422338804582149-4942643

ma006054-andyrouse-lion

1597758-422339274582102-55815901

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics