
"আমেরিকা রিসাইকেলস ডে"; আর বাংলাদেশ ?
ফারজানা হালিম নির্জন
জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নের চেষ্টা মানুষের প্রতিদিনের ভাবনায় বিরাজমান। সোজাসাপ্টা চিন্তা-চেতনা ধারণকারী যেকোনো মানুষকে আমরা অনেক বেশি পছন্দ করি। দুর্বোধ্য-কঠিন-প্যাঁচানো বিষয়গুলো এড়িয়ে যেতে চাই সবসময়। মানুষের এই সহজীয়া মনোভাবের প্রভাব পড়ে তাঁর কাজে। সেই কাজ থেকে তৈরী হয়ে যায় এমন মহৎ কিছু, যা তখন আর ক্ষুদ্র পরিসরেই সীমাবদ্ধ থাকেনা; হয়ে যায় সার্বজনীন। বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় তেমনই এক সহজ-সাশ্রয়ী বৃত্তের পরিধি জুড়ে আমাদের বিচরণ এখন চোখে পড়ার মত। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বৃত্তটি বিন্দুতেই রয়ে গেছে প্রায়, কিন্তু পশ্চিমা-বিশ্বে তার কী অবস্থা! শেখার আছে অনেক কিছুই, যদি ভালটুকু শেখা যায়। ‘রিসাইক্লিং’ অর্থাৎ ব্যাবহার্য জিনিসকে পুনরায় ব্যাবহারের উপযোগী করে তোলা- বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি। সম্পূর্ণরূপে এই বিষয়টির উপর নজর দিয়ে ১৯৯৭ সাল থেকে জাতীয় পর্যায়ে ‘America Recycles Day’ পালিত হয়ে আসছে। প্রতিবছর নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখ আমেরিকাবাসী এই তাৎপর্যপূর্ণ দিনটি নানা উদ্যোগ-উৎসবের আলোকে পালন করেন।
‘রিসাইক্লিং’ এর ধারণার শুরু যে ১৯৯৭ সাল থেকেই, তা কিন্তু নয়। মানুষ জেনে-না জেনে অনেককাল আগে থেকেই এর আশীর্বাদ পেয়ে আসছে। খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০ সালের সেই দার্শনিক প্লেটোর সময়কাল থেকে মূলত রিসাইক্লিং বেশ সমর্থন পাওয়া শুরু করে, যখন সম্পদের অপ্রতুলতা ছিলো অনেক বেশি। মানুষ প্রয়োজনের তাগিদেই এই পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রিসাইক্লিং এর প্রভাব এবং প্রয়োগ অনেকটা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে। যুদ্ধের কারণে সম্পদের ঘাটতির পাশাপাশি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের জন্যেও সাধারণ মানুষেরা ঘরের বিভিন্ন ব্যাবহার্য জিনিস ফেলে না দিয়ে নতুনভাবে ভিন্ন প্রয়োজনের অভাব মেটাতে শুরু করে। তখন বলা হয়েছিলো, ধাতু সামগ্রী দান এবং তন্তু জাতীয় জিনিস সংরক্ষণ দেশপ্রেমের একটি বড় বহিঃপ্রকাশ। এভাবেই ধীরে ধীরে রিসাইক্লিং জড়িয়ে পড়ে মানুষের প্রতিদিনকার জীবনে। আধুনিক বিশ্বের মাটিতে দাঁড়িয়ে “রিসাইক্লিং” নিয়ে জোরালো ভাবে ভাবনার সময় কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। তার গুরুত্ব যথাযথ বুঝতে পেরেই “Keep America Beautiful (KAB)” সংস্থাটি এই “America Recycles Day (ARD)” জাতীয়ভাবে পালন করার উদ্যোগ নেয় সর্বপ্রথম। তাঁদের আয়োজনেই পর্যায়ক্রমে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে বছরের পর বছর। দেশের সর্বস্তরের মানুষদের মাঝে নানান আয়োজন ও কর্মকান্ডের মাধ্যমে রিসাইক্লিং সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী করতে “America Recycles Day (ARD)” একটি মাইলফলকের মত কাজ করছে পুরো বিশ্ব জুড়ে।
বাংলাদেশে প্রায় ১৯৮০ সালের দিক থেকে জাহাজ শিল্পক্ষেত্রে রিসাইক্লিং বেশ তোড়জোর করে শুরু হয়। এমনকি এক পর্যায়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম “শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড” হিসেবে খ্যাতিলাভ করে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে অবস্থিত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড’টি। সেখানে প্রায় ২ লক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োজিত আছেন। তাছাড়া বাংলাদেশের মোট ইস্পাতের প্রায় অর্ধেক আসে এই চট্টগ্রাম শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড থেকে। তারপরেও খারাপ খবর আছে। একমাত্র নিরাপত্তা বা সংরক্ষনের অভাবে সম্প্রতিই (২০১৪ সাল) একটি কোম্পানী এখানে তাঁদের ব্যাবসায় গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র একটি দেশ এবং যে দেশে দুর্যোগ আক্রমনের সম্ভাবনা অনেক বেশি, সেখানে কতটুকু নজর দেয়া হয় রিসাইক্লিং এর ক্ষেত্রে? নিজ নিজ আগ্রহে বা চেষ্টায় ব্যাক্তিপর্যায়ে আমরা কেউ কেউ হয়তো রিসাইক্লিং-এর সাথে পরিচিত এবং অভ্যস্ত। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যতটুকু সচেতনতা আছে সকলের মাঝে, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তা কি আসলেই যথেষ্ট? অনেক ধরণের প্রচারণা বা সচেতনতা যে তৈরী করা হচ্ছেনা, তা নয়। একটু পেছন ফিরে তাকালেই হয়তো খেয়াল করবো, পলিথিন ব্যাগ বা এ জাতীয় যেকোনো সামগ্রীর ব্যাবহার একসময় নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো, যেহেতু পলিথিন পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কিন্তু বর্তমানে? ঐ যে কথায় বলেনা; যেই লাউ, সেই কদু!
ভবিষ্যত পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে টিকে থাকতে হলে, বাংলাদেশকে রিসাইক্লিং-এর সাথে পুরোদস্তুরভাবে অভ্যস্ত করা সত্যিই ভীষণ জরুরী হয়ে পড়েছে। আমরা যদি এখন থেকেই স্কুলের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের মনে রিসাইক্লিং এর এই পুরো বিষয়টি মজার এবং আনন্দদায়ক হিসেবে গেঁথে দিতে পারি, তবে ভবিষ্যতের জন্য আর কোনো চিন্তাই হয়তো করতে হবেনা! এর পাশাপাশি আমেরিকা বা অন্যান্য দেশে কিভাবে রিসাইক্লিং করা হচ্ছে, তা যদি মানার চেষ্টা করি, তবে নিজেরাই অনেক বেশি বুঝতে সক্ষম হবো কিভাবে নতুন নতুন চিন্তার বাস্তবায়ন ঘটানো যায়। চলুন ব্যাবহার্য জিনিসটি ফেলে দেয়ার আগে একটু ভাবি, এর থেকে নতুন কিছু তৈরী করা সম্ভব নয়তো !