ভালবাসতে বাসতেই চলে গেলেন চিরাগ রয়…
ফারজানা হালিম নির্জন
আমরা শহুরে সভ্য মানুষ, প্রকৃতিকে ভালোবাসি কম-বেশি সবাই, তবে একটা অদৃশ্য সীমানার এপার থেকে। যান্ত্রিক মন্ত্রেই আমাদের দিনলিপি রচিত হয় যন্ত্রের কষাঘাতে। তবে আমাদের এই নিয়মমাফিক জীবনযাপনের বাইরে; ক’জন আছেন বেশ ভাগ্যবান! তাঁরা মনের এক অদ্ভুত টানে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকেন। তাঁরাও হয়তো শহরবাসী, তবে শহুরে হওয়াটা তাঁদের আর হয়ে ওঠে না। তাঁরাও প্রচন্ড রকম সাংসারিক! হয়তো একসাথে পুরো সপ্তাহের বাজার করে ঘর্মাক্ত শরীরে হাসিমুখে বাসায় ফেরেন; কিন্তু আবার প্রকৃতির অবাক মায়ার টানে সেখানেও ছুটে যান, মিশে যান আদিম অরণ্যে, সেখানেও সংসার পাতেন খোলা আকাশের নিচে, গহীন অরণ্যের কোলে। বণ্যপ্রাণিদের কে নিজ সন্তানের মত ভালোবেসে একটু একটু করে অজানা কে মেলে ধরতে চান বিশ্বের দরবারে।
বলছিলাম সেইসব প্রকৃতিপ্রেমিদের কথা, বিশেষভাবে বলতে চাচ্ছি তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে একজন অসাধারণ তরূণ ব্যাক্তিত্বের কথা; যিনি প্রকৃতিকে ভালোবেসে, বণ্যপ্রাণিকে ভালোবাসতে বাসতে কিছুদিন আগে চিরতরে চলে গেছেন সকল সীমানার ওপারে। তিনি ‘চিরাগ রয়’, তাঁকে ঘিরে স্মৃতি-বিজড়িত দিনগুলির কথা হয়তো তাঁর খুব কাছের মানুষদের কাছেই সবচেয়ে বেশি অর্থবহ! তবু এই সমস্ত পৃথিবীকে এক পরিবার- এক সংসার ভেবে নিলে তিনি তো আমাদেরই একজন অভিভাবকের মত! প্রকৃতিকে ভালোবাসতে বাসতে যিনি প্রাণ দিতে পারেন, তাঁর সম্পর্কে জানার অধিকার নিশ্চয়ই আমাদেরও আছে!
‘চিরাগ রয়’ নামটির সাথে জড়িয়ে আছে অনেক টুকরো টুকরো হাসি-কান্নার গল্প, ভালোবাসার গল্প। তিনি বাংলাদেশে খুব বেশি পরিচিত না হলেও তাঁর জন্মস্থান ভারতে তিনি এক বিশেষ মহলে বেশ পরিচিত! পরিচিতি লাভের চাইতে নীরবে-নিভৃতে যে মানুষগুলো দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যায় কোনো স্বপ্ন বিজয়ের লক্ষ্যে, তাঁদের হয়তো ইতিহাস মনে রাখে না, তবে মানুষের হৃদয় জয় করে যান তাঁরা নিজের অজান্তেই। চিরাগ রয় তেমনই একজন ব্যাক্তিত্ত্ব ছিলেন।
কাজের সুবাদেই ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম তাঁর বাংলাদেশ ভ্রমণের সুযোগ মেলে। বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের সাথে অজগর সাপে প্রথম ট্রান্সমিটার বসানোর জয়লগ্ন থেকে তাঁর এপার বাংলা-ওপার বাংলায় যাতায়াত শুরু।
তিনি ভারতের নাগপুড় হতে ১৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ‘মহারাষ্ট্র’ প্রদেশের, ‘টাদোবা-আন্ধেরী টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট’-এ টাইগার ট্যুরিজম ইনডাস্ট্রি গাইড হিসেবে কাজ করতেন। কাজের মৌসুমে তিনি ভারতেই থাকতেন, সেই বাঘের অরণ্যে পড়ে থাকতেন দিন-রাত, গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে প্রকৃতিপ্রেমি এই মানুষটি কী এক উদ্যম মাদকতায় ঘুরে বেড়াতেন অরণ্যের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
আর বৃষ্টির মৌসুমে, জুন-জুলাই মাসে চলে আসতেন তাঁর আরেক দেশ বাংলাদেশে। এখানে তিনি বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের সাথেই নানান কাজে কলসাল্ট্যান্ট হিসেবে সহযোগিতা করতেন। একজন মানুষের কাজের প্রতি ভালো লাগা-ভালোবাসা যতখানি উচ্চতায় পৌঁছুলেই অর্থ লাভের আশা না করেই সারা বছর এমন ছুটোছুটি করতে পারেন, তাঁর দৃষ্টান্ত হিসেবে চিরাগ রয় কোন দিক থেকে কম?
‘প্রকৃতিবিদ’ চিরাগ রয়-এর ভিতরে-বাইরে অভিন্ন এক স্বত্ত্বা। তাঁর জীবন রচিত ভালোবাসার ব্যাপ্তিতে। হয়তো এই ‘ভালোবাসা’ শব্দটি দিয়েই একমাত্র তাঁকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ভালোবেসে সাত-পাঁকে বেঁধে নিয়েছিলেন তাঁর সহধর্মীনিকে; গত বছর, ২০১৫ এর জুলাই ৭ এ। ১ম বিবাহ বার্ষিকী আসার আগেই চলে গেলেন কোন সুদূরে ! কিন্তু ভালোবাসা তো মরে যায়নি, বেঁচে আছে, থাকবে চিরকাল। ভালোবেসে কাজ করতেন প্রাণিদের নিয়ে। অসম্ভব সুন্দর ক্যারিকেচার করতেন তিনি! জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চমৎকার ছবি সব তুলতেন। আর এই সব ভালো লাগার কাজগুলোকে বাঁধতেন এক সুতোয়। তাঁর ক্যারিকেচার, ছবি আঁকা, তাঁর আলোকচিত্র সবগুলোই যেন তাঁর কাজের ক্ষেত্রটিকে আরো প্রাণচঞ্চল করে তুলতো, আরো সহজ করে দিতো সবকিছু।
নিশ্চয়ই যারা জানেন না, তাঁদেরও কিছুটা ধারণা হয়ে গেছে, ব্যাক্তি চিরাগ রয় সম্পর্কে। সত্যিই তাই, সবার সাথে সুন্দর ভাবে মিশতে পারা, তাঁর মুখের সেই চিরাচরিত প্রাণোচ্ছ্বল হাসি, সবকিছুকে সহজভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা, এই সবকিছু দিয়ে শান্ত স্বভাবের এই মানুষটি অদৃশ্য এক বেড়াজালে আগলে রাখতেন তাঁর আশ-পাশের মানুষদের। ভুলিয়ে দিতেন সকল জটিলতার ছায়া। তিনি যে পেশা বা কাজের নেশায় ডুবে থাকতেন, সেখানে অসংখ্য ঝুঁকি ছিলো, ভেবে-চিন্তে যেমন সিদ্ধান্ত নিতে হত, তার পাশাপাশি হুট করেও অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হতো। সেই সময়গুলোতে পুরো দলকে হাসি-মুখে আশ্বাস দেয়ার দায়িত্বটা যেন নিজ থেকেই তিনি গ্রহণ করে নিতেন। আদিবাসীদের সাথে সহজ-স্বাভাবিক মেলবন্ধন তৈরি করাটা খুব বেশি সহজ কাজ কিন্তু নয়! কিন্তু চিরাগ রয়ের ভেতর অসাধারণ সেই শক্তি ছিলো, তাঁদেরকে কাছে টেনে নেবার। ঠিক তেমনই বিভিন্ন কর্মশালার নেতৃত্বে তিনি যখন থাকতেন, তখন বিদেশি শিক্ষিত-সভ্য মানুষদের সাথেও কত সহজেই না হাসাহাসিতে মেতে উঠতেন! কে বলবে, দিন-রাত আদিবাসী শিশুদের সাথে কাঁদায় মাখামাখি করা চিরাগ রয়ই বিদেশি বন্ধুদের কফির টেবিলে প্রাণোচ্ছ্বল আড্ডার ঝড় তুলছে !
তাঁর বন্ধু, সিজার, স্কট ফাজলামো করে তাঁকে একটা নাম দিয়েছিলেন! মুরং ভাষায় যাকে বলে ‘ক্লাক’ ! অতিরিক্ত ধীর-গতির এক প্রাণির নামে এই নাম! বৃষ্টির সময় বাংলাদেশের দুর্গম পাহাড়ি এলাকাতেই ছিলো চিরাগ, সিজার দের বিচরণ। পাহাড়ে উঠতে চিরাগের বরাবরই বেশ কষ্ট পোহাতে হতো! অরণ্যের মানুষ বলেই হয়তো পিছল পাহাড়ের কাছে একটু বেসামাল হয়ে পড়তেন তিনি, কে জানে! সবসময়ই সিজার আর স্কটের পিছনে পড়ে রইতেন তিনি, আর বন্ধুরা দুষ্ট-মিষ্ট ফাজলামো তে ‘ক্লাক’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেন। দীর্ঘকায়, সুঠাম দেহের চিরাগ হাসতেন, সেই প্রাণখোলা হাসি।
একবার এক পাহাড়ি এলাকায় ভুট্টা খাওয়ার পর চিরাগের শরীরে লাল লাল দাগ বসে যায়, এলার্জির জন্যই হয়তো বা! আবার কিছুদিন পর ঐ এলাকায় কাজ করতে আসলে তখনো তাঁর একই দশা হয়! বন্ধুরা সবাই মিলে ঐ এলাকার নাম দেয় ‘খুঁজলি পাড়া’ ! বিষহীন সাপের কামড় খেয়েও চিরাগের জ্বর চলে আসতো ! বন্ধুরা মজা করে বলতেন, চিরাগ হয়তো একদিন সাপের কামড়েই মারা যাবে। সব শুনে বরাবরের মতই চিরাগ হাসতেন, সেই মায়াভরা প্রাণ-কাড়া হাসি… কে জানতো, সত্যিই চিরাগের মৃত্যু লেখা ছিলো সাপের কামড়ে।
১৯৮৯ সালের ২৯ মে, চিরাগ রয়ের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, কলকাতায়। তাঁর পূর্ব পুরুষদের বাসস্থান ছিলো বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়। দেশবিভাগের পর সীমারেখা আঁকা হয়ে গেলেও চিরাগের মনে কোনো সীমারেখা ছিলোনা কোনদিন। তাঁর বেড়ে উঠা কলকাতায়, নাগপুড়ে। স্কুল ছিলো দার্জিলিং-এ। বোর্ডিং স্কুলের পরিবেশে একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠা ছোট্ট চিরাগের তখন থেকেই প্রকৃতির জন্য অন্যরকম টান, মায়া।
কলকাতায় তিনি ব্যাচেলর ডিগ্রী নেন। এরপর কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই আপন ভালোবাসার ক্ষেত্রে কাজ করার সুবিধার্থে কলকাতায় ফরেস্ট্রি বিষয়ের উপর ডিপ্লোমা করেন তিনি। বাবা-মা’য়ের একমাত্র সন্তান চিরাগ রয়। পরিবারের ভালোবাসাও পেয়েছেন অগাধ, তাই হয়তো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার এর বেড়াজালে আবদ্ধ না হয়ে, প্রাণিদের কাছে নিজেকে উজাড় করার পেশায় বা নেশায় বাঁধা আসেনি কখনো পরিবার থেকে।
তবুও অকালেই চলে যেতে হলো তাঁকে। ২০১৬ এর মার্চ এর ১ তারিখ, বেলা ১২ টা নাগাদ বিষধর গোখরা সাপের কামড়ে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়। ভালোবাসার কাজে, ভালোবাসতে বাসতেই তাঁকে চলে যেতে হলো। হয়তো মৃত্যুর ওপার থেকে তিনি এখনো হাসছেন, হয়তো তিনি এমনটাই চেয়েছিলেন, কে জানে !
চিরাগ রয়ের স্বপ্ন ছিলো, তাঁর নিজের একটি ট্যুরিজম কোম্পানী হবে। নিজের মত করে সাজাবেন তাঁর সমস্ত ভালোবাসার টুকরো টুকরো অংশগুলো। সেভাবেই এগুচ্ছিলেন তিনি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে সেই স্বপ্নযাত্রা শুরুও করেছিলেন মাত্র। পরিপক্ক্বতা দেয়ার আর সুযোগ পাওয়া গেলো না।
২০১৪ সালের জুনে, বান্দরবানে বিলুপ্তপ্রায় আরাকান ফরেস্ট টারটেল পাওয়ার অভিযানে চিরাগ রয় সঙ্গী ছিলেন শাহরিয়ার সিজার-এর। এ নিয়ে যে গবেষণা পত্রটি তৈরি হয়, তার স্বত্ত্বাধিকার শিরোনামেও চিরাগের নাম আছে। বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের এই সার্থক পথচলায় অনেক খুঁটিনাটি সাফল্যের পেছনে তাঁর নীরব উপস্থিতি আছে। অর্থায়নের জন্য কর্মশালার আয়োজনের বুদ্ধিটা চিরাগই প্রথম দেন সিজারকে।
সর্বপ্রথম অজগরের শরীরে ট্রান্সমিটার বসানোর অস্ত্রপচার নিয়ে যখন সবাই বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, তখন চিরাগ শান্ত ভঙ্গিতে পাইপের ভেতর অজগরের শরীর ঢুকানোর বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু সহজ করে দিলেন নিমিষেই। সম্প্রতি গাজীপুরের ভাওয়ালে কচ্ছপ গবেষণার জন্য সামগ্রিক নকশা এঁকে কাজটাকে আরো সুবিধার করে দেন তিনি। এমন বহু বহু অবদান রেখে গেছেন চিরাগ এপার বাংলায়। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘের পায়ের ছাপ পাওয়ার পর সবার আগে চিরাগের কাছেই সেই ছবি পাঠান সিজার। চিরাগ প্রাথমিক গবেষণা করে এ ব্যাপারে আশার কথা জানান। মার্চের ১ তারিখেই তাঁদের এই অবাক তথ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ছাপা হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বশেষ কথা হওয়ার পর, এই সুসংবাদ পরদিন আর চিরাগ শুনে যেতে পারেন নি।
সুখবর শোনানোর আগেই কলকাতা থেকে দূরাভাষের মাধ্যমে সিজারের কাছে আসে এই আকস্মিক শোক সংবাদ। বন্ধু শাহরিয়ার সিজারের সাথে তাঁর একটি যৌথ স্বপ্ন ছিলো, দু’জন একটি বই লিখবেন, সাধারণ মানুষের জন্য। কিছু স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই থেকে যায়। এমন অনেক অসমাপ্ত স্বপ্ন আকাশে ছড়িয়ে দিয়ে চিরাগ রয় চলে গেলেন।
শাহরিয়ার সিজার এর কাছ থেকে, বিষন্ন মেঘলা এক বিকেলে , শান্ত লেকের পাড়ে বসে যখন বন্ধু চিরাগের এইসব স্মৃতির কথামালা শুনছিলাম, ফাঁকে ফাঁকেই তিনি নানান বাহানায় থেমে যাচ্ছিলেন, কখনো চা খাওয়ার জন্য উঠে পড়ছিলেন, কখনো সব কথা থামিয়ে দিয়ে লেকের পানির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে কী যেন খোঁজার চেষ্টা করছিলেন আনমনে… সবকিছু ছাপিয়ে যে চোখের জল গোপন করার ব্যার্থ চেষ্টা করছিলেন এই গম্ভীর মানুষটি, তা বুঝার জন্য বারবার জন্ম নিতে হয় না। চিরকাল হাস্যোজ্জ্বল বন্ধু চিরাগ এভাবেই বেঁচে থাকুক তাঁর কাছের মানুষদের হৃদয়ে, আমাদের হৃদয়ে!