প্রাণীদের ভূমিকম্প পূর্বানুভূতি হয় কি!
মোঃ সাইফুল ইসলাম
নীল আকাশ, কোন মেঘের নিশানা নেই। খাঁ খাঁ করছে মাঠ। বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছে প্রাণি-পাখি, কৃষক, ছোট বড়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবাই। উত্তরবঙ্গে খরার সময় এমন দৃশ্য খুবই চোখে পড়তো। হঠাৎ কেন যেন ব্যাঙ ডাকতে শুরু করলো। সাথে সাথে সবার মনে আনন্দের আভাস দেখা দিতো। কারন কি? মা বলতেন আজ বৃষ্টি হবে! ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি হয়। বিশ্বাস হতো না। তবে ঠিকই দেখতাম বিকেল অথবা রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আবার উইপোকা উড়লেও বৃষ্টি হবে এমনটি শুনতাম।
বৃষ্টির পূর্বাভাস পাবার জন্য এখন আর আমাদের ব্যাঙের ডাক শুনতে হয়না। আমরা এখন খুব সহজেই ঝড় বৃষ্টির জন্য পূর্বাভাস পেতে পারি। কিন্তু ভূমিকম্পের জন্য কি হবে? এর পূর্বাভাস পাবার মত কার্যকর কোন প্রযুক্তি আমাদের হাতে এখনো নেই। তাছাড়া ভূমিকম্প কোন প্রকার পূর্বাভাস ছাড়াই আঘাত হানে। আমরা ভূমিকম্প বোঝার প্রায় ১১ সেকেন্ডের মাঝেই তা শুরু হয়।
পরিবেশের আকস্মিক কোন পরিবর্তন ঘটলে প্রাণিদের আচরনেও পরিবর্তন দেখা যায়। অথাৎ প্রাণিরা আগে থেকেই বুঝতে পারে এমন দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। কিছুকিছু ঘটনা এসব দাবির পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
২০০৮ সালে চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার পূর্বে হাজার হাজার ব্যাঙ রাস্তায় উঠে এসেছিল। চীন সরকার বলেছিল তারা বংশবিস্তারের নিমিত্তে হয়ত অবস্থান পরিবর্তন করছে। কিন্তু কেউ সতর্ক হয়নি। তারপর সৃষ্ট ভূমিকম্পে প্রাণহানি ঘটেছিল ৬৯ হাজারের বেশি!
২০১০ সালের ৯ জানুয়ারীতে ইউরেকা শহরের Times standard newsroom এর একটি ঘটনা। সিসি ক্যামেরায় দেখা যায় ৬.৫ মাত্রার ভূকম্পন শুরুর আগেই সফি নামের কুকুরটি বুঝতে পারে এবং ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
২০০৩ সালে জাপানের এক ডাক্তার জানান কুকুর হঠাৎ অতিরিক্ত ঘেউ ঘেউ করে অথবা কামড়ানোর মাধ্যমে ভূমিকম্পের আভাস দেয়।
জাপানের ওরফিস (oarfish) ভূমিকম্প শুরুর একদিন আগেই তীরে উঠে আসে বলে জানিয়েছে ডি নিউজ (Dnews)।তারা আরো বলেন ২০০৪ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সুনামিতে অনেক লোক মারা গেলেও প্রাণি মৃতের সংখ্যা তেমন ছিল না। তাদের মতে প্রাণিদের শ্রব্যতার সীমার ভিন্নতার জন্য তারা বুঝতে পারে। সাধারণত মানুষের শ্রাব্যতার সীমা ২০-২০০০০ হার্র্টজ। অপরদিকে গরু ১৬-৪০০০০ হার্টজ এর শব্দ শুনতে পায়। তখন প্রাণিরা অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। তারা প্রজনন, খাওয়া বন্ধ করে দেয়। হাতি, মথ, কীটপতঙ্গেরও অস্বাভাবিক আচরনের কথা জানান তারা। পরিশেষে তারা জানান প্রাণিরা ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দূর্যোগের আভাস পূর্বেই বুঝে থাকে।
২০১৫ সালের ২৪ মার্চ ডেইলি মেইলে সারাহ গ্রিফিথ্স এর গবেষণা প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় প্রাণিরা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম।
ডেইলি মেইলের তথ্যমতে, বিজ্ঞানীরা পেরুতে প্রথম ভূমিকম্পের পূর্বে বন্য প্রাণিদের আচরণের ছবি তুলতে সক্ষম হন। তারা জানান Pumas Ges Razor billed curassow birds ঘটনার আগেই নিরাপদ স্থানে চলে যায়। গবেষকদের মতে বাতাসে পজিটিভ আয়নের বৃদ্ধির কারনে এমনটি হতে পারে। গবেষকদের প্রধান ছিলেন অ্যাংলিয়া রাসকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণি ও পরিবেশ জীববিদ্যার অধ্যাপক ড. রাসেল গ্রান্ট। তিনি জানান সাধারণত ভূমিকম্পের ২৩ দিন পূর্ব থেকে প্রাণিদের আচরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ঘটনা ঘটার ৫-৭ দিন পূর্বে আর কোন প্রাণির ছুটাছুটির দৃশ্য ক্যামেরায় আসেনি। অর্থাৎ নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছে। তিনি আরো জানান গর্তবাসী প্রাণীরা বেশি সংবেদনশীল। তাদেরকে প্রায় ৮ দিন পূর্ব থেকেই ক্যামেরায় পাওয়া যায়নি।
গ্রান্টের সহযোগী গবেষক অ্যাস্ট্রোনোমি ও অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের ফ্রিউন্ড এবং পিয়েরে রাউলিন গবেষণা করে জানান সাধারণত কম্পন শুরুর আগে আয়নোস্ফিয়ারের (পৃথিবীর বায়ুম-লীয় পর্দা) পরিবর্তন ঘটে। যাতে প্রচুর আয়ন ও মুক্ত ইলেক্ট্রন থাকে এবং এরা প্রচুর রেডিও তরঙ্গ প্রতিফলিত করে। এই প্রতিফলন দুই সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হয়। সাধারণত আট দিন পূর্বে এটি বেশি হয়।
তবে গবেষকদের মতে পজিটিভ আয়নের কারনেই হয়ত প্রাণিরা এমন আচরণ করে থাকে। এই আয়ন রক্তে সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে প্রাণির সেরোটোনিন সিনড্রোম দেখা দেয়। অর্থাৎ প্রাণির মাঝে ছটফটানি, উৎকন্ঠা, কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি ও বিশৃঙ্খলতা বাড়ে। তারা বলেন তাদের এই গবেষণা ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পেতে খুবই সহায়ক হবে এবং এ বিষয়ে আরো অনেক গবেষণার প্রয়োজন আছে।
যাইহোক, প্রাণিরা বিভিন্ন কারনেই অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে। অসুস্থ্য হলে, পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বাসস্থানের সমস্যা হলেও এদের আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। তবে এদের আচরণ অস্বাভাবিক হলে কোনভাবেই অবহেলা করার দরকার নেই। অসুস্থ্য মনে হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। আর যদি মনে হয় প্রাণিটি কোন আশু বিপদের আশঙ্কায় ছটফট করছে তবে সাবধান হোন।
লেখক: ইন্টার্ণশীপ শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)।