প্রাণিদের চলন ও পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র
রইসউদ্দিন রাকিব
প্রাণিদের একস্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণকে ইংরেজিতে সাধারণত এনিমেল নেভিগেশন বলা হয়। বাস্তুতন্ত্র এবং জীব বৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার। প্রাণিদের খাবার সংগ্রহ, জনন, বিস্তার ইত্যাদিতে এর রয়েছে অনস্বীকার্য তাৎপর্য। শীতকালে আমাদের দেশে অতিথি পাখিদের আগমন এর একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পরিযায়ী পাখিরা কোন ম্যাপ কিংবা কম্পাস ছাড়া কিভাবে চলাচল করে? তাছাড়া সামুদ্রিক কাছিমরা সামুদ্রিক আবহাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে থাকে। ক্ষুদ্র মৌমাছি থেকে শুরু করে আপনার সখের কবুতরটিও কিন্তু কোন ম্যাপ,কম্পাস কিংবা জিপিএস প্রযুক্তি ব্যতিরেকে দিন শেষ ঠিকই নীড়ে ফিরে আসে! কিন্তু কিভাবে এরা এই অসম্ভবকে সম্ভব করে?
বিংশ শতাব্দীর দিকে কার্ল ভন ফ্রেস প্রথম দেখান মৌমাছিরা প্রধানত সূর্যের অবস্থানের উপর নির্ভর করে পথ পাড়ি দেয়, এমনকি তারা আকাশের আলোর পোলারাইজেশনকেও কাজে লাগাতে পারে! তিনি আরো প্রস্তাব করেন যে মৌমাছিরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়ে পথ চিনে নিতে পারে। উইলিয়াম টিনসলে কেটোর গবেষণাতেও দেখা যায় গৃহপালিত কবুতরেরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সাহায্যে পথ চলে। তবে এক্ষেত্রে ঠিক কোন রাসায়নিক পদার্থটি মেকানিজমে অংশ নেয় তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। কোন কোন গবেষক এর জন্য সাইট্রোক্রোমকে দায়ী করে থাকেন আবার কেউ কেউ ম্যাগনেটাইটকে। প্রথম তত্ত্ব মতে সাইট্রোক্রোমে নীল আলো এসে পরলে দুটি ননপেয়ার ইলেকট্রন নির্গত হয়, আর এই ইলেকট্রন পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়।
যার দরুণ সাইট্রোক্রোমের ক্রিয়াকলাপ প্রভাবিত হয় এবং প্রাণিরা বিশেষ করে পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বুঝতে পারে। তবে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের তীব্রতা খুবই কম, মাত্র ০.৫ গাউস! এই দুর্বল চৌম্বক ক্ষেত্র দ্বারা এই ধরনের রাসায়নিক পরিবর্তন সম্ভব কিনা তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। দ্বিতীয় মতবাদ অনুযায়ী অথিতি পাখিদের উপরের ঠোঁটে ম্যাগনেটাইট দিয়ে তৈরি একধরনের ম্যাগনেটো রিসেপ্টর থাকে যা দিয়ে তারা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বুঝতে পারে। তবে সম্প্রতি টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক Caenorhabditis elegans নামক মাটিতে বসবাসকারী একধরনের নেমাটোড ওয়ার্মের দেহ থেকে একটি নির্দিষ্ট নিউরনকে সনাক্ত করেছেন যার অগ্রভাগে টিভি এ্যন্টেনার মত দেখতে একটি অংশ ম্যাগনেটো রিসেপ্টর হিসেবে কাজ করে বলে তারা দাবি করছেন (ছবির সবুজ অংশটি) ।
এ ব্যাপারে eLife জার্নালে একটি গবেষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছে। আমরা আজকের পৃথিবীর যে চৌম্বক মেরু দেখছি তা লক্ষ লক্ষ বছর আগে ঠিক এর উল্টো ছিল! দক্ষিন মেরু ছিল উত্তরে আর উত্তর মেরু ছিল দক্ষিনে। সামনে হয়তো আবারো মেরুর পরিবর্তন হবে। এর ফলে হয়তো অধিকাংশ জীব বৈচিত্র্যই নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু আশার ব্যাপার হলো, তা হতে এখনো অনেক দেরি !