
সমুদ্র দিবসে একটি সচেতনতামূলক লেখার আত্মকাহিনী
মোহাম্মদ আরজু
উপলক্ষের লেখা বড়ই জটিল ব্যাপার; এইরকম মনে হচ্ছে। অবশ্য ব্যাপারটির দোষগুণ বলে যদি কিছু থাকে, তবে ওইটা নিশ্চয় উপলক্ষেরই হবে, লেখার নয়। এই যেমন ধরেন বেশ মাসখানেক আগেই ভেবেছিলাম ‘বিশ্ব সমুদ্র দিবস’ উপলক্ষে কিছু লিখালিখি করবো । এখন যদি মনে করার চেষ্টা করি; যে কেন এমনধারা ভেবেছিলাম? মনে পড়তেছে; একটা কর্তব্যবোধের থেকে এই ভাবনা আসছিলো, কর্তব্যের খাতিরে যা কহতব্য তা কইবো, এমন আর কি। কিন্তু এরপর থেকে আর লেখার তাড়নাটা পাইতেছিলাম না নিজের থেকে। কেনো পাইতেছিলাম না, সেইটা খোঁজ করে যে দেখবো, সেই তাড়নাও ছিল না।

এই লেখাটি লিখতে লিখতেই এখন কিছুটা খোঁজ করা গেলো। মনে হইতেছে; গত দুইমাসে সমুদ্র দিবস ও সমুদ্র বিষয়ে নানা লোকেদের ও প্রতিষ্ঠানের সাথে গভীর যোগাযোগের অভিজ্ঞতার থেকে এই না লিখবার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এই সময়ের যোগাযোগের মধ্যে আমরা দেখেছি যে, প্রায় সবাই-ই আসলে এইসব বিষয়াদির ব্যাপারে সচেতন। মানে সবার চিত্তের সঙ্গে রয়েছে সমুদ্র ও সমুদ্রকে জানা ও সুরক্ষার ধারণা। সংশ্লিষ্ট সবাই’ই তাদের নিজ নিজ কর্তব্য করতেছেন, কোনো লিখালিখি ছাড়াই।
যেমন ধরেন, ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেই সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হইছে, ওই বিভাগের জনাব চেয়ারম্যান কাওসার স্যারের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম সমুদ্র দিবস পালনের নিমন্ত্রণ নিয়ে। যদিও জানা গেলো, শিক্ষায়তনিক নিবিড় ব্যস্ততার কারণে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ এই বিশ্ব সমুদ্র দিবসের মত নানা উপলক্ষ পালন করে শক্তি-সামর্থ্য খরচ না করবার একটা সিদ্ধান্তমূলক অবস্থানে রয়েছে।
কিন্তু আলাপে এইসব জেনে খুবই ভালো লাগলো, যে বিভাগের থেকে ওনারা কি একনিষ্ঠভাবে জাতীয় সামর্থ্যের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যতসামান্য সহায়-সম্পদ ব্যবহার করেই সমুদ্র-শিক্ষা-গবেষণায় উদ্যোগী হয়েছেন। সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত এত বেশি সংখ্যায় গবেষণামূলক-অভিযাত্রায় এই বিভাগ থেকে সাগরে যাচ্ছেন ছাত্র-শিক্ষকরা। ফলে উপলক্ষের লেখা বা বক্তৃতামালা না করলে কি আসে যায়। কাজটা তো হচ্ছে।
একইভাবে নবপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামুদ্রিক বিষয়াদির যেই শাখা রয়েছে ওনারাও অবিরাম কর্মরত। আর যারা দরিয়ার সন্তান, সেইসব উপকূলবাসীতো নিজেদের জীবিকা ও সমুদ্র-সম্পর্কের মধ্যেই রয়েছেন। এমনকি সম্প্রতি সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের লোকেরা তো ‘আঁরার দইজ্জা আঁরার জীবন’ শ্লোগান তুলে সম্পর্ক ও সুরক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন। উপকূলের লোকেদের জন্য সমুদ্র দিবসের বিশেষ কোনো দরকার আমি দেখি নাই। সুরক্ষা ও সম্পর্কের মধ্যেই তাদের জীবন ও জীবিকা, সচেতনতাও আলাদা করে দরকার হয় তাদের। এদিকে আমরা নিজেরাও ‘মেরিন কনজারভেশন ও ব্লু ইকনমি সিম্পোজিয়াম’ নিয়া যারপরআরনাই ধরণের ব্যস্ততার মধ্যে আছি। ফলে লেখা আর হয়ে ওঠে নাই।
তাছাড়া ‘সচেতনতা’ বিষয়ে আমার নিজের মধ্যে কখনো সখনো অস্বস্তিও কাজ করে বটে। কারণ জগতে মানুষের জীবনে জড়িত কোনো বিষয়ে মানুষদের ‘চেতনা নাই’ এমন অবস্থা, মানে অ-(স)চেতন আমি বিশেষ দেখি নাই। ‘কি করিলে কি হইবে’ সে কমবেশি সবার চিত্তেই আছে। আর কিভাবে নিজের ‘ভালো হইবে’ সেই উপায়ের তালাশে থাকে সাধারণ লোকে। ফলে সাধারণ লোকেদের যদি সেই ভালো করবার ‘ক্ষমতা’ থাকে, তবে তারা ভালোই করবে; এই বিষয়ে আমার বিশেষ সন্দেহ নাই।
কেউ যদি ধরেন সাগরে এক জাহাজ পরিমাণ তেল ঢেলে দিয়ে আসে, আর সাধারণের ওই বিষয়ে ভিন্ন ধারা কিছু করবার ক্ষমতা না থাকে, তবে ওই সচেতনতাশুদ্ধই সাধারণকে ও সাগরকে তেলচুপচুপ হয়ে থাকতে হবে। সাগরের তীর ঘেষে যদি চারশ কারখানার থেকে দিনরাত অবিরাম বিষাক্ত তরল ফেলা হয় সাগরে, তবে সচেতনতা যে ওইটা বন্ধ করতে পারবে না, সেইটা সবাই বোঝেন। তো সাধারণের এই ক্ষমতা নাই কেনো? এইটা কোনো কাজের প্রশ্ন বইলা আমার মনে হয় নাই। ক্ষমতা এমনি এমনি তো থাকে না। বোধ করি; এই বস্তু তৈরি করতে হয়।
মোহাম্মদ আরজু: প্রধান নির্বাহী, সেভ আওয়ার সি
arju@saveoursea.social