
বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট – সরীসৃপ সংরক্ষণে যুগান্তকারী গবেষণা
ফারজানা হালিম নির্জন
“পরিবেশের জন্য প্রতিটি প্রাণিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো না কোনোভাবে তারা নিয়মিত উপকার করে যাচ্ছে,কেউ চাক্ষুসে,কেউ বা নীরবে। যেমন; গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়,তা আমরা চোখে দেখতে পাইনা,কিন্তু অনুভব করতে পারি। এমনি করে সৃষ্টিকর্তার প্রতিটি সৃষ্টিই পরিবেশের জন্য খুব উপকারী ” -এমন কিছু কথাই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম তাঁর কাছ থেকে। যিনি বিপন্ন প্রাণিদের নিয়ে চিন্তা করছেন সাধারণ মানুষদের থেকে একটু ভিন্নভাবে। আর তাই,প্রকৃতিতে বিপন্ন প্রাণিদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে শুরু করেছেন এই পথযাত্রা। তিনি ‘বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট’-এর প্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার সিজার রাহমান। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর সাথে কথা বলার। সেই সাথে উত্তর পেলাম আমাদের মনের অনেক আকাংক্ষিত প্রশ্নের।
“বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট” এর প্রধান উদ্দেশ্য মূলত সরীসৃপ নিয়ে গবেষণা এবং সংরক্ষণ করা। তবে অজগর সাপকে প্রাধান্য দিয়েই তাঁরা অন্যান্য বিপন্ন প্রাণিদের নিয়ে ধীরে ধীরে গবেষণা শুরু করছেন। বর্তমানে তাঁরা কাজ করছেন বার্মিজ অজগর (Python bivittatus) এবং সোনালী কচ্ছপ/হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ (Indotestudo elongata) নিয়ে। সংরক্ষণের সুবিধার্থে ব্যাটারী আকারের ছোট্ট একটি ট্রান্সমিটার অজগর এবং কচ্ছপের শরীরে স্থাপন করে পুনরায় ওদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন অরণ্যে। এই পদ্ধতিতে রেডিও ট্র্যাকিং এর মাধ্যমে ওদের গতিবিধি,বাস্তুতন্ত্র,ওদের শারীরতাত্ত্বিক পরিস্থিতি কিংবা প্রকৃতিতে ওরা কিভাবে লড়াই করে বেঁচে থাকছে অথবা কেউ শীকার করছে কিনা –এ ধরণের যাবতীয় তথ্য বিস্তারিতভাবে রেকর্ড করা হচ্ছে। এর ফলে ওদের নিয়ে গবেষণা করা যাচ্ছে খুব সহজেই,আর তাতে করে আবিষ্কৃত হচ্ছে এসব বিপন্ন প্রাণিদের সংরক্ষণের উপায়।
বান্দরবানে বাস করছে অনেক প্রজাতির সরীসৃপ,যারা হরহামেশাই আদিবাসীদের শিকারে পরিণত হচ্ছে, কিংবা ধ্বংস করা হচ্ছে ওদের আবাসস্থল। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে বিপন্ন প্রাণি সহ অনেক প্রাণিদেরই আমরা বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলবো। কচ্ছপ বিলুপ্ত হওয়ার প্রধান কারণই হলো মানুষের খেয়ে ফেলা। সেই সম্ভাবনা টের পেয়ে “বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট” প্রাথমিকভাবে সোনালী কচ্ছপের দিকে নজর দিয়ে তাঁদের যাত্রা শুরু করেছেন। যেহেতু আদিবাসীরা বহুকাল আগে থেকে এই পেশায় বা নেশায় জড়িয়ে,তাই একদিনে তাঁদের স্বভাব চাইলেও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আর তাই পাইথন প্রজেক্টের গবেষকগণ সেইসব আদিবাসীদের জন্য বিকল্প সমাধান করে দিবেন। তাঁরা ছাগল কিংবা মুরগীর খামার করে দিবেন আদিবাসীদের জীবন-ধারণের জন্য। বিনিময়ে আর কোনো প্রাণি যেন কখনো শিকারে পরিণত না হয়! আর সম্প্রতিই পাইথন প্রজেক্টের অধীনে ৮ টি সোনালী কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়েছে,যাদেরকে নিয়ে গবেষণার প্রথম ধাপ শুরু হয়ে গেছে। এর মাঝে ৬ টি কচ্ছপ উদ্ধার করা হয়েছে বান্দরবান থেকে এবং বাকি দুটি লাউয়াছড়া থেকে। এদের শরীরে ট্রান্সমিটার স্থাপন করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে লাউয়াছড়া অরণ্যে। গবেষকগণ দেখতে চান, কচ্ছপগুলো নতুন পরিবেশে কিভাবে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, আসলেই পারছে কিনা এবং সেখানে কেউ শিকার করছে কিনা ! উদ্দেশ্য প্রধাণত দুটোই। লাউয়াছড়ার মত ছোট অরণ্যে ওরা বাঁচতে পারবে কিনা, আর ওদের শিকার বন্ধ করা সম্ভব হবে কিনা। লাউয়াছড়া কেন? সব জায়গায় ওদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, তাই ওদেরকে টিকিয়ে রাখতে হলে কিছু কিছু জায়গা নির্ধারণ করা উচিত, যেখানে ওরা ঘুরে-ফিরে-খেয়ে নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকতে পারবে। একবছর পর বলা সম্ভব হবে, ওদের সংরক্ষণের উপায়টি কেমন হবে! তবে আশার কথা জানালেন তিনি। রেডিও ট্র্যাকিং-এর মাধ্যমে তাঁরা জানতে পেরেছেন- এই তিন মাস যাবৎ ওদের কোনো সমস্যা হয়নি এবং কেউ শিকারও করে নি। ওরা স্বাধীনভাবে লাউয়াছড়া অরণ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।এতো প্রাণি থাকতে অজগরই কেন? কারণ বেশিরভাগ মানুষের সাপের প্রতি ভয় কাজ করে,সেই অর্থে সাপ বেশ অবহেলিত প্রাণি। আর বার্মিজ অজগর বিপন্ন প্রাণির তালিকায় রয়েছে। তাই বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে ক’জন টিকে আছে,ওদেরকে টিকিয়ে রাখা খুব খুব জরুরী। বাংলাদেশে; সুন্দরবন ছাড়া বেশিরভাগ জায়গাতেই কিন্তু সবচেয়ে বড় মাংশাসী প্রাণি হিসেবে অজগরই টিকে আছে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ৪ টি সাপের মধ্যেও অজগর একটি। খাদ্য শৃংখলের উপরের স্তরে ওদের বসবাস। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কিন্তু নীরবে পালন করে যাচ্ছে ওরা। অজগরকে কৃষকের বন্ধুও বলা হয়ে থাকে। অনেক ইঁদুর খেয়ে ফেলে ওরা ফসলের সুস্থভাবে বেড়ে উঠায় নীরবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে এটিও একটি বিরাট উপকার, যা আমরা চোখে দেখতে পাই না। সেজন্য, বিপন্ন প্রাণি বার্মিজ অজগরের গুরুত্ব্ উপলব্ধি করেই ২০১৩ সালে ৪ টি সাপের শরীরে ট্রান্সমিটার বসানো হয়েছে। এগুলো খোলা হবে আগামী বছর। তাছাড়া তাঁদের পরিকল্পনা রয়েছে, মোট ১০ টি সাপের শরীরে ট্রান্সমিটার স্থাপন করা।
বাংলাদেশে অজগরের মোট সংখ্যার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি নির্ভুলভাবে বলা সম্ভব নয়। অজগর কিংবা অন্য যেকোনো সাপের ক্ষেত্রেই এটা নির্ণয় করা বেশ কঠিন। মানুষের শুনানি মাথা গুণে খুব সহজেই করা যায়, বাঘ পায়ের ছাপ রেখে যায়, কিন্তু অজগর এমনই এক প্রাণি, যা প্রকৃতিতে কোনোপ্রকার চিহ্ন তো রেখে যায়ইনা, বরং লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে। মোটামুটি ৫-১০ বছরের একটি গবেষণা করলে ওদের মোট সদস্য সংখ্যার ব্যাপারে আন্দাজ করা সম্ভব হলেও হতে পারে।
এতো এতো পরিকল্পনা ও গবেষণার কথা শুনে কেউ যদি খুব আগ্রহী হয় “বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট”-এর সাথে কাজ করার, তাঁদের নিরাশ হবার কোনো কারণ নেই। তাঁদের জন্যেও সুবর্ণ সুযোগের ব্যাবস্থা রেখেছেন প্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার সিজার রাহমান। তিনি বলেন, অনেকেই কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ইতিমধ্যে। কেউ কেউ করছে্নও। তবে প্রধান যে বিষয়টি,সেটি হচ্ছে দক্ষতা এবং সময় মিলিয়ে কাজ করার ক্ষমতা। তাছাড়া ফিল্ড-ওয়ার্ক এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি সত্যিকার অর্থেই রোমহর্ষক। তাই পরিপূর্ণ দক্ষতা ছাড়া এ কাজে এগুনো ঠিক হবেনা। তবে তাঁদের সাথে কাজ করার আরো অনেক মাধ্যম আছে। লেখালেখি, ওয়েবসাইট ডেভেলপিং, মার্কেটিং ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে দক্ষ যে কেউ এগিয়ে আসতে পারেন সদিচ্ছায়। তাঁরা বেশ আগ্রহের সাথে স্বাগতম জানিয়েছেন সবাইকে।
এই ব্যাতিক্রমী উদ্যোগে “বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট”-এর প্রতিষ্ঠাতা –শাহরিয়ার সিজার রাহমান-এর সাথে একত্রে কাজ করছেন, Centre for Advanced Research in Natural Resources & Management (CARINAM) এর প্রধান নির্বাহী ড.এস.এম.এ. রশীদ।জনাব রশীদ এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ পাইথন প্রোজেক্ট এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ বন বিভাগের সহায়তায়। এছাড়া স্থায়ীভাবে কাজ করছেন শ্রীমঙ্গলের ফুলবাড়ি চা বাগানের ২ জন স্থানীয় কর্মী,সেচ্ছাসেবক আছেন অনেকেই,যারা সময়মতো এসে কাজ করেন। তাছাড়া শিক্ষানবিশ হিসেবেও কাজ করছেন অনেকে। ইতিমধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ জন ও শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন শিক্ষানবিশ হয়ে কাজ করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়। যেমন, “ইন্টারন্যাশনাল ভলান্টিয়ার প্রোগ্রাম”। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট ওয়ার্কশপ এর মাধ্যমে আমেরিকা,অস্ট্রেলিয়া ও মেক্সিকোর মোট ৮ জন সেচ্ছাসেবী কাজ করে গেছেন। এই আয়োজনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, এই সচেতনতাটিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া। এছাড়াও আন্তর্জাতিক অজগর বিশেষজ্ঞ যারা আছেন,তাঁরা প্রযুক্তি উপদেষ্টা হিসেবে নানাভাবে সাহায্য করছেন।
এভাবেই তিনি জানালেন অজগর ও কচ্ছপ নিয়ে অজানা সব তথ্য, শোনালেন তাঁদের প্রজেক্ট নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা।
প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকা এসব প্রাণিদের বাঁচিয়ে রাখতে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে সচেতনতা। তাহলেই, “বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট” যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তা একদিন পূর্ণতা পাবে, পৌঁছে যাবে সফলতার শিখরে।