
বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট; বিপন্ন সরীসৃপ রক্ষার্থে আশার আলো!
ফারজানা হালিম নির্জন
সাপ নিয়ে ভীতি, খুব সাধারণ একটি ব্যাপার। আর যদি হয় অজগর, তাহলে তো ভয়ের মাত্রা সেই তুঙ্গে! তবে ভয় নয়, ভালোবাসায় সিক্ত হয়েই অজগরকে বন্ধু হিসেবে কাছে টেনে নিয়েছেন বাংলাদেশের যুবক, শাহরিয়ার সিজার রাহমান। সরীসৃপ নিয়ে গবেষণামূলক একটি অলাভ-জনক প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট’ এর পথচলা তাঁর হাত ধরেই। অজগর সাপ সহ অন্যান্য সরীসৃপ নিয়ে গবেষণা এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। আর বাংলাদেশে অজগর সাপে সর্বপ্রথম তাঁরাই ট্রান্সমিটার স্থাপন করে রেডিও-ট্র্যাকিং এর মাধ্যমে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করছেন।
শাহরিয়ার সিজার জানান, বাংলাদেশে দুই প্রজাতির অজগর সাপ রয়েছে। রেটিকুলেটেড অজগর এবং বার্মিজ অজগর। বাংলাদেশে বার্মিজ অজগরের পরিমাণ তুলনামূলক বেশি হলেও, ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার’ (আইইউসিএন) কর্তৃক বিপন্ন প্রাণির তালিকায় উঠে এসেছে এ প্রজাতির অজগরের নাম। উত্তর-সুন্দরবন, লাউয়াছড়া, পার্বত্য চট্টগ্রামে বার্মিজ অজগর বেশ সুখে-শান্তিতে বসবাস করলেও ওদের জীবনে মাঝে মাঝে নেমে আসে ভয়ংকর কালরাত্রি। প্রায় না বুঝেই শুধুমাত্র ভীতি থেকে ওদেরকে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সুন্দরবন ছাড়া বেশিরভাগ জায়গাতেই অজগর এখনো সবচেয়ে বড় মাংসাশী প্রাণি হিসেবে টিকে আছে। প্রাকৃতিক খাদ্য-শৃংখল রক্ষায় ওদের ভূমিকা অসামান্য। আর পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ৪ টি সাপের মধ্যে কিন্তু অজগর একটি। অথচ এশিয়ার নেটিভ এই অজগর কে নিয়ে এশিয়াতে তেমন কোনো গবেষণাধর্মী কাজ হচ্ছেনা। সবকিছু বিবেচনায় রেখেই, ভালবাসাপূর্ণ হৃদয়ে একটি একটি করে দিন গবেষণার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছেন বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের গবেষক দল। তাঁদের প্রধান অস্ত্র রেডিও ট্রান্সমিটার। কিন্তু জিনিসটা কী? কেমন করে হচ্ছে এতোকিছু?
এ পর্যন্ত ৭ টি বার্মিজ অজগরের (Python bivittatus) শরীরে ছোট্ট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ট্রান্সমিটার স্থাপন করা হয়েছে। ট্রান্সমিটারটি খুবই ছোটো, আকারে একটি পেন্সিল ব্যাটারির মত। রেডিও সংকেতের মাধ্যমে একটি সংগ্রাহকে অজগরের গতিবিধি সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য রেকর্ড করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেভাবে আমরা আলাদা এবং নির্দিষ্ট ফ্রিকুয়েন্সিতে এফ.এম. রেডিও চ্যানেল টিউন করে গান শুনি, ঠিক সেভাবেই অজগরের জন্য একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকুয়েন্সি ১৪৪.২০০ মেগা হার্জ টিউন করে গবেষকগণ ট্রান্সমিটারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তবে ট্রান্সমিটার থেকে ২ কিলোমিটার দূরত্বের এলাকার মধ্যে এটি করতে হয়। আর সাথে সাথেই সকল তথ্য সংগ্রহ করা হয় সংগ্রাহকে। বাংলাদেশে এর আগে কচ্ছপে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো হয়েছিলো, তবে অজগর সাপে রেডিও ট্রান্সমিটার বসিয়ে গবেষণা এই প্রথম। জানিয়ে রাখা ভালো, বর্তমানে বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট শুধু অজগর নিয়েই ব্যস্ত নয়, এর পাশাপাশি তাঁরা সোনালী কচ্ছপ/হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ (Indotestudo elongata) নিয়েও সমানতালে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। রেডিও-ট্রান্সমিটার প্রযুক্তি টি বাংলাদেশে নতুন মনে হলেও পশ্চিমা বিশ্বে কিন্তু এর ব্যবহার শুরু হয়েছে সেই ৭০’ এর দশকে। আর এর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার দেখা যায় আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের শুরু? সেই ২০০৯ থেকে। আমেরিকার ফ্লোরিডাতে বসবাসরত শাহরিয়ার সিজার প্রথম উপলব্ধি করলেন, বাংলাদেশে অজগর সাপ নিয়ে গবেষণা শুরু করা উচিত। এবার চিন্তাকে কাজে রূপ দেয়ার পালা। ২০১১ সালে তিনি দেশে আসেন। ছোটো-খাটো কিছু চড়াই-উৎড়াই পেড়িয়ে অবশেষে বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট তাঁদের গবেষণা শুরু করেন। পথচলার একেবারে শুরুতেই অর্থায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বেসরকারি সংস্থা, ‘ওরিয়েন সোসাইটি’। সাধারণত অজগর সাপ খুঁজে পাওয়া বেশ কষ্টকর। ওরা লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। মাঝে মাঝে হাঁস খাওয়ার জন্য ওরা জঙ্গলের আশে পাশের গ্রামে ঢু মারে। লাউয়াছড়া সংলগ্ন ৩০ টি গ্রামে ঘুরে ঘুরে, গ্রামবাসীর সহায়তায় অবশেষে ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে তাঁরা প্রথম বার্মিজ অজগর সাপ খুঁজে পান। অজগর সাপ, তাই বলে কি কোনো নাম থাকবে না? ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ ওর নাম রাখা হয় আশা, ইংরেজী তে ‘হোপ’। অনেক আশা নিয়ে আশা’র শরীরেই সর্বপ্রথম ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ট্রান্সমিটার বসানো হয়। আর সেইসাথে শুরু হয় বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের স্বপ্নযাত্রা। পর্যায়ক্রমে ২০১৪ পর্যন্ত মোট ৪ টি অজগরের শরীরে ট্রান্সমিটার বসিয়ে পুনরায় ওদের ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো লাউয়াছড়ায়। ২০১৫ তে এসে বর্তমানে তাঁরা মোট ৭ টি বার্মিজ অজগর কে এবং ৮ টি হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপকে ট্র্যাকিং করছেন। এখনো ওরা নিজেদের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে লাউয়াছড়ার আনাচে-কানাচে। এই ট্রান্সমিটারগুলোর স্থায়ীত্বকাল ২ বছর। যাদের ইতিমধ্যে ২ বছর পার হয়ে গেছে, তাদের শরীর থেকে ট্রান্সমিটার খোলা হবে ২০১৫ সালেই, এইতো আর কিছুদিন পরই। তারমানে কি গবেষণা শেষ? মোটেই না। শাহরিয়ার সিজার জানান, সেই মুহুর্ত থেকেই তাঁদের নতুন করে কাজ শুরু। আপাতত এ বছর মোট ৪ টি অজগর সাপে ট্রান্সমিটার বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের, যারমধ্যে ৩ টিতে বসানো হয়ে গেছে! পরিকল্পনা রয়েছে কচ্ছপ নিয়েও। এই বছর নতুন মোট ৬ টি কচ্ছপে ট্রান্সমিটার বসানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন তাঁরা। এভাবেই চলছে দিন-রাত পরিশ্রম, এবং চলতেই থাকবে। ২০১১ তে অজগরের দেখা না পেলেও গবেষণা থেমে থাকেনি। লাউয়াছড়ার বিভিন্ন প্রজাতির সাপ নিয়ে তাঁরা গবেষণা চালাতে থাকেন। নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এখন পর্যন্ত তাঁদের বাংলাদেশের সাপ নিয়ে মোট ৩ টি রিসার্চ আর্টিকেল এবং ২৪ টি শর্ট নোট প্রকাশিত হয়েছে। আর অজগর নিয়ে তথ্য সংগ্রহ তো চলছেই এখনো।
সামান্য কিছু অর্থ নিয়েই বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট যাত্রা শুরু করে। তবে যত দিন যাচ্ছে, বাড়ছে কাজের পরিধি,পরিকল্পনা…সেই সাথে বাড়ছে বার্ষিক বাজেটের পরিমাণও। তাই বলে পিছপা হন নি গবেষকদল। নিজেদের আগ্রহ ও ভালোবাসাকে পুঁজি করেই একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অর্থের ভিত্তিতে এই অলাভ-জনক প্রতিষ্ঠানটিকে।
এতো এতো পরিকল্পনা ও গবেষণার কথা শুনে কেউ যদি খুব আগ্রহী হয় বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট-এর সাথে কাজ করার, তাঁদের নিরাশ হবার কোনো কারণ নেই। তাঁদের জন্যেও সুবর্ণ সুযোগের ব্যবস্থা রয়েছে। শাহরিয়ার জানান, ইতিমধ্যে অনেকেই কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ করছে্নও। তবে প্রধান যে বিষয়টি দরকার,সেটি হচ্ছে দক্ষতা এবং সময় মিলিয়ে কাজ করার ক্ষমতা। তাছাড়া ফিল্ড-ওয়ার্ক এর ক্ষেত্রে ব্যপারটি সত্যিকার অর্থেই রোমহর্ষক। তাই পরিপূর্ণ দক্ষতা ছাড়া এ কাজে এগুনো ঠিক হবেনা। তবে তাঁদের সাথে কাজ করার আরো অনেক মাধ্যম আছে। লেখালেখি, ওয়েবসাইট ডেভেলপিং, মার্কেটিং ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে দক্ষ যে কেউ এগিয়ে আসতে পারেন এই প্রতিষ্ঠানের সাথে। গবেষকদল বেশ আগ্রহের সাথে স্বাগত জানিয়েছেন সবাইকে।
এই ব্যাতিক্রমী উদ্যোগ, বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের সাথে একত্রে কাজ করছেন বন্যপ্রাণি গবেষণা সংগঠন ‘সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন ন্যাচারাল রিসোর্সেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’ অর্থাৎ ক্যারিনামের প্রধান নির্বাহী ড.এস.এম.এ. রশীদ এবং সেই সাথে বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরও সর্বোচ্চ সহায়তা করছে। এছাড়া স্থায়ীভাবে কাজ করছেন শ্রীমঙ্গলের স্থানীয় কর্মী, স্বেচ্ছাসেবক আছেন অনেকেই, যারা সময়মতো এসে কাজ করেন। আর ইন্টার্নশীপও করছেন অনেকে। ইতিমধ্যে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ জন ও শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন ইন্টার্নশীপ করেছে্ন। এর বাইরেও বিভিন্ন প্রোগ্রামের আয়োজন করা হয়। যেমন, “ইন্টারন্যাশনাল ভলান্টিয়ার প্রোগ্রাম”। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট ওয়ার্কশপ এর মাধ্যমে আমেরিকা,অস্ট্রেলিয়া ও মেক্সিকোর মোট ৮ জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করে গেছেন। এই আয়োজনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, এই সচেতনতাটিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া। এছাড়াও আন্তর্জাতিক অজগর বিশেষজ্ঞ যারা আছেন, তাঁরা প্রযুক্তি উপদেষ্টা হিসেবে নানাভাবে সাহায্য করছেন। বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট দুর্গম এলাকা পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ‘ক্যামেরাস ফর কনজারভেশন’ নামে আরেকটি উদ্যোগ সমানতালে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আদিবাসিদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে কিছু ক্যামেরা এবং আদিবাসিদের সহায়তায় অনেক অজানা তথ্য সরাসরি রেকর্ড করা হচ্ছে ক্যামেরায়। তাঁদের প্রত্যাশার চেয়ে বেশি পরিমাণে সাড়া পাচ্ছেন এই অভিনব উদ্যোগের মাধ্যমে। এভাবেই নিত্য-নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁদের গবেষণার ক্ষেত্র।
“সবকিছুর শুরুতে প্রয়োজন নিজের ইচ্ছা আর ভালোবাসা। এগুলো নিজের ভেতর ধারণ করলেই যেকোনো বাঁধা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।” বাংলাদেশে্র পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরণের গবেষণা একটু কষ্টসাধ্য হলেও এমন কিছু আশার কথা শোনালেন বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার সিজার। আর এই প্রজেক্ট নিয়ে তাঁর স্বপ্ন? প্রশ্নটি করার পর চকচকে চোখ দুটোই জানিয়ে দিলো, স্বপ্নটা অনেক বিশাল। তবে প্রকাশ করলেন খুব কম। মুচকি হেসে জানালেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সাধারণত বন্য-প্রাণি নিয়ে বড়জোর ২-৪ বছর কাজ হয়, তারপর শেষ হয়ে যায়। দেশের বাইরে যেমন ২০-৩০ বছর ধরে কাজটিকে এগিয়ে নেয়া হয়, সেভাবেই এগুতে চান তিনি। এমন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার সাথেই জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট ঘিরে তাঁর স্বপ্নের পরিধি। বিপন্ন প্রাণি সংরক্ষণের জন্য সবার আগে জানতে হবে ওদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে। যার জন্যই এই গবেষণা শুরু। তাছাড়া আমাদের দেশে এ ধরণের কাজ যত বেশি হবে, বাংলাদেশ সম্পর্কে তত বেশি জানবে পুরো বিশ্ব। এমন বিশ্বাস মনে লালন করেই নীরবে-নিভৃতে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট।
কিছুদিন আগেই শাহরিয়ার সিজার তাঁর গবেষক দল নিয়ে প্রায় দুই মাসের মত সময় কাটিয়ে এসেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায়। কিন্তু কেন? সম্পূর্ণ নতুন ধরণের কিছু পরিকল্পনাকে স্বপ্নের সীমানা থেকে বাস্তবতায় নামিয়ে আনতেই ছিলো সেই ভ্রমণের উদ্দেশ্য। খুব শীঘ্রই সেসব মহৎ উদ্যোগের কথা তুলে ধরা হবে। শাহরিয়ার সিজার এখনো ছুটছেন, সাথে ছুটছেন তাঁর গবেষক দল, নতুন কোনো গবেষনার নেশায়, নতুন কোনো স্বপ্ন পূরণের পথে…