পাখি বাঁচাতে বাংলাদেশের পথচলার ত্রিশ বছর!
দিব্য কান্তি দত্ত
১৫ জানুয়ারি টিএসসিতে নাকি পাখি নিয়ে প্রদর্শনী! ব্যাপারটা জেনেই আগ্রহ জাগলো যাওয়ার। ঘুরে দেখার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন সহকর্মী নির্জন আপু। বরাবরের মতই গুরুত্বপূর্ণ কোথাও যেতে আবারও দেরী করে ফেললাম। টিএসসিতে ঢুকেই পাওয়া গেল নির্জন আপুকে, আর আমি পেলাম চোখ রাঙানী। এনাম স্যারের সাথে নাকি এতোক্ষণ গল্পগুজব করছিলেন। শুনে আমারও আগ্রহ হলো; স্যার কোথায় জানতে চাইতেই আপু বললেন, স্যার কি একটা কাজে বেরিয়ে গেলেন মাত্র। এবার তো আক্ষেপই হল। শুকনো মুখ দেখে আপু জানালেন, স্যারের আবার আসার কথা আছে। “চলো, এবার তাহলে প্রদর্শনীর দিকে এগোই। কত সুন্দর সুন্দর পাখির ছবি রয়েছে”,আপু বললেন। পা বাড়ালাম সেদিকে।
এতো গেল পাখিশুমারির ৫০ বছর এবং বাংলাদেশে পাখিশুমারির ৩০ বছর উপলক্ষে আয়োজনের দ্বিতীয় দিনের শুরুর দিকের গল্প। তার আগের দিন অর্থাৎ ১৪ জানুয়ারী ‘জাতীয় প্রেসক্লাব’র ভিআইপি লাউঞ্জে হয়ে গেছে আলোচনা সভা যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিখ্যাত পরিবেশবিদ ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ যিনি বর্তমানে ‘ইউএনএফসিসিসি’ এর ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন আপসকামী’ দলের সমন্বয়কারী এবং ‘বিকেএসএফ’র সভাপতি। সেখানে সভাপতিত্ব করেন ‘বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব’র সভাপতি নিয়াজ আব্দুর রহমান।
আলোচনা সভা দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথম ভাগে ছিল বক্তব্য প্রদান যেখানে নিজস্ব মতামত এবং অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেন ইনাম আল হক, মুকিদ মজুমদার, ইশতিয়াক উদ্দিন আহমাদ, ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, ড. সাজেদা বেগমের মত নামকরা পরিবেশবিদেরা। তারা পাখিশুমারীর ইতিহাস, উপকূলীয় এলাকায় পাখিশুমারীর অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের পাখি সংরক্ষণ, বাংলাদেশে পাখি বিষয়ক গবেষণা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
এরপর চলে কিছুক্ষণের বিরতি। এরপর শুরু হল দ্বিতীয় পর্ব, যেখানে ছিল মুক্ত আলোচনা। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল- “পাখিশুমারির জন্য স্বেচ্ছাসেবক আকৃষ্টকরণ”। এখানে পাখিশুমারির বিভিন্ন দিক এবং স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ করার ধরণ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সবাইকে পাখিশুমারির জরিপ বিষয়ক বিভিন্ন কাজে যোগদান করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়।
১৫ তারিখ দেরী করার ফলে সকালের র্যালীতে অংশগ্রহনের সু্যোগটাও হাত থেকে ফসকে গেল। আপু বলল, সকাল দশটায় নাকি আয়োজক ‘বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব’, ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’ এবং তাদের সহযোগী হিসেবে থাকা ‘আইইউসিএন বাংলাদেশ’র সদস্য এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের অংশগ্রহণে পাখি সচেতনতা বিষয়ক একটা র্যালী হয়ে গেছে।
যাইহোক, প্রদর্শনীর দিকে হাঁটতেই দেখা হল হাস্যেজ্জ্বল তারেক অণু ভাইয়ার সাথে। হাসিমুখে আমন্ত্রণ জানিয়েই আমাদের ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন বিভিন্ন পাখির ছবি। কয়েকটা ছবি দেখানোর পরই তার কোন একটা কাজের জন্য ডাক পড়ল। ওদিকে যাওয়ার আগে হাসিমুখেই বলে গেলেন ঘুরে ঘুরে ছবিগুলো দেখতে আর প্রশ্নগুলো জমিয়ে রাখতে। উনি এসে উত্তর দেবেন। আমরাও ঘুরে দেখতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের চোখ আটকে গেল ‘বামনরাঙা’ নামের ছোট্ট একটা পাখির ওপর। কিছুক্ষণ পর অণু ভাইয়া ফিরে আসতেই তার কাছে এমন নামকরণের কারণ জানতে চাওয়া। উত্তরে তিনি বললেন, এগুলো আসলে ‘মাছরাঙা’, তবে আকৃতিতে ছোট অর্থাৎ বামনের মত হওয়ায় এর নামকরণ করা হয়েছে ‘বামনরাঙা’। এরপর ‘মাছরাঙা’ নিয়েই গল্প জুড়ে দেয়া গেল আবার। ভাইয়ার কাছ থেকে বিষ্ময়কর একটা তথ্য পাওয়া গেল গল্পের ভিতরেই। বাংলাদেশে নাকি মাছরাঙার ১২ টা প্রজাতি রয়েছে যেখানে পুরো উত্তর আমেরিকায় এর প্রজাতির সংখ্যা মাত্র এক! এরপর ভাইয়া আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, আমরা আবার ঘুরে দেখতে শুরু করলাম।
এই পাখি শুমারির শুরুটা কিন্তু হুট করে হয়নি। ইউরোপের অনেক দেশই বহু আগে থেকেই পাখি গণনার কাজ করতো। কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে পাখি শুমারি শুরু হয় ৫০ বছর আগে। এশিয়াতে ৩০ বছর আগে ২০ টি দেশ সংঘবদ্ধভাবে পাখিশুমারি শুরু করে যার মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশ। প্রথমে বনবিভাগ এবং ‘নেকম’ নামের একটি এনজিও এই কাজের সাথে যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে অন্যান্য সংস্থাও এ কাজে যুক্ত হয়। ‘বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব’ ২০০০ সাল থেকে এই দায়িত্ব পালন করে আসছে। ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক ২০০০ সাল থেকে এর জাতীয় সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’ ২০১৪ সাল থেকে ‘বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব’র সাথে এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছে।
জানুয়ারীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে সারাবিশ্বে জলাভূমির পাখি গণনা করা হয়। এর মাধ্যমে সারাবিশ্বে সংরক্ষণের দাবীদার পাখিগুলো চিহ্নিতকরণ এবং পাখিগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ হয়ে থাকে। এছাড়া একই কাজ করা হয়ে থাকে পাখিগুলোর আবাসস্থল গণণার মাধ্যমে। পাখিশুমারির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে হাওর, বিভিন্ন জলাভূমি ও উপকূলীয় অঞ্চলকে। ‘ওয়েটল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান সর্বপ্রথম পাখি শুমারির তত্ত্বাবধানে আসে এবং বর্তমানেও তারা নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
এদিকে যখন আপনারা পাখিশুমারি সম্পর্কে এত কাহিনী জেনে ফেললেন ওদিকে কিন্তু তখনও আমাদের প্রদর্শনী দেখা ঠিকই চলছিল। সব ছবিতে একটা পাখি, কিন্তু ‘নদী টিটি’ লেখা ফ্রেমটাতে দুটো পাখির ছবি দেখা গেল। দুটো পাখি আবার দুরকম।
এ নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হল আমার আর আপুর ভিতরে। কিছুক্ষণ পর আবার পাওয়া গেল অণু ভাইয়াকে। তার কাছ থেকে জানা গেলো আসলে কোনটা ‘নদী টিটি’। আপুর ধারণা ঠিক হওয়াতে তার মুখে দেখা গেল দিগ্বিজয়ী হাসি। বাংলাদেশের পাখির প্রজাতি সম্পর্কে অণু ভাইয়ার কাছে জানতে চাওয়াতে বেশ কিছু বিষ্ময়কর তথ্য বের হয়ে এল আবারও! বাংলাদেশের প্রায় ২৬ প্রজাতির হাঁস পাওয়া যায় এবং পুরো উত্তর আমেরিকায় সংখ্যাটা এর চেয়ে কম! পুরো বাংলাদেশে পাখির প্রজাতি রয়েছে ৬৭০ টি যেখানে ব্রাজিল এবং পেরুর মত বড় দেশগুলো যথাক্রমে ২০০০ টি এবং ১৪০০ টি প্রজাতি নিয়ে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ চিনে সংখ্যাটা ১২০০ এর মত আর পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হাজারের কিছু বেশি। ফিনল্যান্ডের মত বাংলাদেশের চেয়ে বড় দেশে পাখির প্রজাতি মাত্র ৩০০।
জলাভূমির পাখি গণনা সম্পর্কে জানতে চাইলে অণু ভাইয়া বললেন, বনের পাখি গণনার চেয়ে জলাভূমির পাখি গণনা তুলনামূলক সহজ হওয়ায় পাখিশুমারির জন্য জলাভূমিগুলোকেই বেছে নেয়া হয়। এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভাইয়া জানালেন তাদের স্বপ্নের কথা। ৪০ বছর আগে বাংলাদেশের বন থেকে ময়ূর হারিয়ে গেছে। অন্য প্রজাতির পাখিগুলোর ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটুক এমনটা তারা চাননা। তার বাক্যে, “আমরা চাই পাখির এই বৈচিত্র্য হারিয়ে না যাক। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের চিনুক, তাদের সম্পর্কে জানুক।”
কথাগুলোর জন্য ধন্যবাদ দিতেই ভাইয়ার সেই হাস্যেজ্জ্বল মুখ। আমন্ত্রণ জানালেন বনানীতে ওনাদের ক্লাবের আড্ডায়। ওনার সাথে ছবি তুলতে চাইতেই হাসিমুখে উত্তর, “অবশ্যই, কেন নয়?” ছবি ওঠার পর বিদায় নিলাম। আবার স্বাগতম জানালেন ওনাদের যে কোন ইভেন্টে যে কোন সময়।
বের হওয়ার সময় ইনাম স্যারকে সারাদিন না পাওয়ার আক্ষেপটা থেকেই গেল। অগত্যা, কি আর করা…
স্যারকে পরে পাওয়া গেল ফোনে। ইভেন্ট সম্পর্কে জানতে চাইতেই স্যার বললেন তাদের শুরুর কথা। “আমাদের শুরুটা হয়েছিল ২০ বছর আগে শুধুমাত্র পাখি দেখার আনন্দ নিয়ে। প্রায় ১৭ বছর আগে আমরা পাখিশুমারির কাজ শুরু করি। ২০১০ সাল থেকে শুরু হয় পাখির পায়ে রিং পড়ানোর কাজ। ধীরে ধীরে আমরা আরও কঠিন কাজগুলো হাতে নিচ্ছি।” পাখি সংরক্ষণের বিষয়ে স্যার বললেন রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ বৃদ্ধির কথা। “আমরা পাখিশুমারির কাজ করে সরকারকে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির তথ্য সরবরাহের কাজটি করছি। আমাদের পক্ষ থেকে সংরক্ষণের জন্য আমরা যতটুকু সম্ভব করছি। তবে বৃহৎ উদ্যোগটা সরকারের পক্ষ থেকেই কাম্য।”
স্যার আরও জানালেন, আজ একটি দল রওনা হয়ে গেছে হাকালুকি হাওরের উদ্দেশ্যে। ১৭ জানুয়ারী আরও একটি দল রওনা হবে টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশ্যে। সেখানে জরিপ এবং পাখির পায়ে রিং পড়ানো শেষে ফিরবে দল দুটি। এভাবে ১৭-৩০ জানুয়ারী পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে পাখিশুমারির পাশাপাশি পাখির পায়ে রিং পড়ানোর কাজ চলবে। এছাড়া ‘বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব’ এবছর মার্চ থেকে জুলাই মাসে ১৫ টি বিশেষ বনে জরিপের কাজ করবে।
স্যারকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন রাখলাম। লিখতে লিখতেই ভাবছিলাম, দেশের আনাচে-কানাচে চেনা বা না চেনা অসংখ্য পাখি নিয়ে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এই আকর্ষণীয় আর মহৎ উদ্যোগের কথা। চল্লিশ বছর আগে বন থেকে হারিয়ে যাওয়া ময়ূরের সৌন্দর্য আহরণে আমরা ব্যর্থ। পাখিসম্পদে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের আর কোন প্রজাতিকে হারিয়ে যেতে দেয়া নিশ্চয়ই আমাদেরই পরিবেশের বৈচিত্র্য নষ্ট করবে যার দায় বর্তাবে আমাদেরই ওপর। পাখি নিয়ে সচেতনতা তৈরির ইভেন্ট, দেশ ঘুরে পাখি দেখে বেড়ানোর কাজটা বেশ মজাদারই লেগেছে। ভাবছি সু্যোগ পেলে চলে যাব কোন একটা দলের সাথে দেশের কোন এক প্রান্তে।
‘বাংলাদেশে বার্ড ক্লাব’, ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন’ এবং ‘আই ইউ সি এন বাংলাদেশ’র এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ।