
এক অন্যরকম বন্ধুত্বের সবুজ বার্তা; পৃথিবীতে অসম্ভব বলে কিছু নেই!
মনিজা মনজুর
বন্ধু মানে একসাথে অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া। বন্ধু মানে তোমার-আমার সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি। বন্ধু মানে সব প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে একসাথে এগিয়ে চলা। হোক না সে যে কোনো প্রতিবন্ধকতা। বন্ধুত্বের আসল সংজ্ঞা টা যে কী তা আমরা নিজেরাই জানিনা! বন্ধুত্ব নিয়ে গল্পের শেষ নেই। কিন্তু বাস্তবের কিছু গল্প রূপকথাকেও হার মানায়।
আজ আপনাদের এমনই এক বন্ধুত্বের গল্প বলব। চীনের জিয়া হাইজিয়া এবং জিয়া ওয়েঙ্কির গল্প। এই দুই বন্ধু মিলে প্রায় ১০,০০০ গাছ লাগিয়েছেন। ভাবছেন, এ আর এমন কী বন্ধুত্বের গল্প! বলছি।
এই দুই বন্ধুর একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, অন্যজনের দুটি হাত নেই। হাইজিয়া জন্মেছেন জন্মগত ছানি নিয়ে। পরবর্তীতে ২০০০ সালে এক দুর্ঘটনায় তাঁর আরেকটি চোখও নষ্ট হয়ে যায়, আর তিনি হয়ে যান পুরোপুরি অন্ধ। অন্যদিকে মাত্র তিন বছর বয়সে ওয়েঙ্কি দুর্ঘটনায় তাঁর দুই হাত হারান। কাজের খোঁজ করতে করতে ২০০১ সালে দেখা হয় তাঁদের দু’জনের। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক কঠিন সংগ্রাম করে জীবন যাপন করেন তাঁরা। কিন্তু ৫৩ বছর বয়সী এই দুই বন্ধুর কর্ম পরিকল্পনায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি এতোটুকুও। একে অপরকে বলেছেন, “বন্ধু, তোমার চোখ নেই তো কী হয়েছে? তুমি আমার চোখে দেখবে”। আর অপরজনের উত্তর, “তাহলে আজ থেকে আমার হাত তোমার হাত হয়ে তোমার পাশে থাকবে”।
মানুষের চোখ রাঙ্গানি আর পৃথিবীর নেতিবাচক মনোভাবকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ১০ বছরের মধ্যে ১০,০০০ এর ও বেশি গাছ লাগিয়েছেন এই দুই বন্ধু। জীবন কোনো কিছুর জন্য থেমে থাকে না। কেউই হাল ছেড়ে দেয় না। তাই ভবিষ্যতের সুরক্ষায় এবং নিজেদের জীবিকার তাগিদে তাঁরা চীন সরকার থেকে তিন একর জমি লীজ নেন। কাজ শুরু করেন স্বপ্ন পূরনের লক্ষ্যে। এই জমিকে একটি পূর্ণ বনায়নে রূপ দিতে চান তাঁরা।
প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে কাজ শুরু করেন। কাজে যেতে নদী পারাপারে প্রবল স্রোতের মুখে পড়লে হাইজিয়ার কাঁধে চড়ে নদী পাড়ি দেন ওয়েঙ্কি।
আর্থিক সংকটের কারণে অনেক সময় নতুন চারা কেনা সম্ভব হয়না। তখন পুরোনো গাছের ডাল থেকে নতুন জীবনের সঞ্চার করেন তাঁরা। গাছ কাটতে ওয়েঙ্কির চোখেই দেখেন হাইজিয়া।
ওয়েঙ্কি আর হাইজিয়া বলেন, “যদিও কাজটি অনেক দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। কিন্তু যখন আমাদের লাগানো গাছে ফল ধরতে দেখি, তখন সব কষ্ট, সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। ফলন হয়তো অনেক সময় ভালো নাও হতে পারে। কিন্তু আমরা চেষ্টা তো করেছি। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে জানি। আমরাও কিছু করে দেখাতে পারি। মনে মনে একটা অপার্থিব শান্তি অনুভব করি”।
তাঁদের এই মহৎ উদ্যোগে অনেকেই ইতিমধ্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এক শুভাকাংখী ওয়েঙ্কির ছানি প্রতিস্থাপনের আশ্বাস দিয়েছেন। অনেকেই তাঁদের খাদ্য-বাসস্থানের নিরাপত্তার জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেছেন।
মনের জোরের কাছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বরাবরই হার মানে। তা আবারো বন্ধুত্বের শক্তিতে প্রমাণ করলেন ওয়েঙ্কি এবং হাইজিয়া। একটি ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন? আমরা সবাই গাছ কে আমাদের বন্ধু বলি। আর এই দুই বন্ধু মিলে গাছের সাথে সমগ্র বিশ্বেরই বন্ধুত্বের একটা শিকল তৈরি করে দিয়েছেন! আর আমরা অনেকেই দেখেও দেখি না, হাতটা বাড়িয়ে দেই না। মানবতা বেঁচে থাকুক, বন্ধুত্ব বেঁচে থাকুক।