স্মৃতি ও বাস্তবতায় ব্রহ্মপুত্র নদ
মোঃ সাইফুল ইসলাম
ব্রহ্মপুত্র নদ উৎপত্তিস্থল থেকে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত এর দৈর্ঘ্য ২৯০০ কিলোমিটার। এর প্রধান শাখা হচ্ছে যমুনা। বাংলাদেশের দীর্ঘতম এই নদ এখন শীর্ণকায় মরা খালে পরিণত হয়েছে। নদের বুকে জেগে উঠেছে অনেক চর। যা শুধুই অনাবাদিত বেলে মাটি দ্বারা পরিবেষ্ঠিত। ফলে কৃষি উৎপাদনও আর আগের মত নেই। এককালে দেশের অভ্যন্তরেই প্রায় ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার মানুষের বসতি। বৃটিশ আমলে গড়ে ওঠা চিলমারী বন্দরও ছিল এই নদের তীরে। বন্দরটি কুড়িগ্রাম জেলা সদর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এই বন্দরে বড় বড় জাহাজ চলত ব্রিটিশ আমলে। আসামের ধুবড়ী নৌবন্দর এবং নারায়নগঞ্জ বন্দরে চিলমারী থেকে পণ্য নেয়ার ব্যবসা হত এ পথে। এখন নাব্যতা সংকটে এই নদের পরিবেশ শুধুই স্মৃতি।
বর্তমানে শুকনো কিংবা ভরা উভয় মৌসুমেই ছোট ছোট ইঞ্জিন চালিত নৌকা চলে। জেলে পরিবারগুলো এখন আর আগের মত নদের আশির্বাদ পায়না। কৃষকের সেচের পানির জোগানও আর দেয়না এই নদ। প্রমত্তা নদ এখন তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছে।
এবার ঈদুল-আযহার ছুটিতে স্থানীয় এক ছেলে বাদশা মিয়াকে সাথে নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার রাজিবপুর উপজেলাধীন কোদালকাটি ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরের কয়েক কিলোমিটার এলাকা ভ্রমণ করি। সেদিন হয়তো আমরা কয়েক কিলোমিটার এলাকা ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছিলাম কিন্তু এই কয়েক কিলোমিটার এলাকাই এখন পুরো ব্রহ্মপুত্রের প্রতিচ্ছবি। সর্বত্রই একই অবস্থা। আজকের এই লেখায় মূলত নদের কিছু পরিবেশ তুলে ধরার চেষ্টা করব।
নদের তীরের ভাঙ্গন: নদের ভাঙ্গনে সর্বশান্ত হয়ে পথে বসেছে হাজার হাজার এলাকাবাসী। ভাঙ্গনের পর নদের তীরবর্তী হাজার হাজার একর জমি বেলেমাটিতে ভরে যাচ্ছে।
নাব্যতা সংকটের কারণে জেগে ওঠা বেলে মাটির চরে তেমন ভাল ফসল ফলানোর উপায় জানা নেই চরের বাসিন্দাদের। শুষ্ক মৌসুমে বাদামের ফলন দেখা গেলেও ভরা মৌসুমের ফসল তোলা হয়ে ওঠে না এখানকার কৃষকদের। সামান্য বন্যা কিংবা ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে নদের পাড়ের ফসল তলিয়ে যায়। একদিকে অনাবাদী জমি তার উপর আবার দেশের সামগ্রিক পরিবেশ বিপর্যয়। সব মিলে অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি, অসময়ে সৃষ্ট বৃষ্টির কারণে ডুবে নষ্ট হওয়া ফসলে কৃষকের মাথায় হাত পড়ে যায়।
মৎস্য সম্পদ: এক সময়ে সারাদেশের ন্যায় ব্রহ্মপুত্র নদেও মিলত নানা প্রজাতির মাছ। জেলেরা বড় বড় জাল ফেলে মাছ ধরতেন। মাছে ভাতে বাঙ্গালী এখন বেগুন ভাতে বাঙ্গালীতে পরিণত হচ্ছে। সারাদিন ঘুরে স্থানীয় একটি বাজারে যাই নদের মাছের সন্ধানে। কিন্তু পুকুরের মাছ ছাড়া নদের মাছ নেই বললেই চলে। কয়েক জন জেলে জানান, এখন আর নদীতে মাছ নেই। তাই বাপ-দাদার পেশা ধরে রাখতে হিমসিম খাওয়ার মত অবস্থা তাদের। মাছ বিক্রি করে আর দিনকাল ভাল যাচ্ছেনা। আজ থেকে পাঁচ সাত বছর আগেও জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য ছিল। এখন আর তেমন চোখে পড়েনি সেই দৃশ্য। নদের পাশে একটি খাল থেকে তোলা ছবিতে ব্যাঙ দিয়ে নির্দয়ভাবে মাছ ধরার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। ষাটোর্ধ এক ব্যক্তি তিন চার দিন আগে রেখেছেন এটি। কথাও বলেছিলাম তার সাথে। তিনি জানান আগে এভাবে বড় বড় বোয়াল মাছ ধরতাম। এখন পাইনা। নদীও মরছে আমাদেরকেও মারতেছে।
একটি শিশুর কেঁচো দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্যও তুলে নেই। এই নদ এবং নদের প্রধান শাখায় দেখা মিলত মেছো কুমির তথা ঘড়িয়াল, শুশুক, নানা প্রজাতির মাছ, কচ্ছপ। হরেক প্রজাতির দেশি বিদেশী পাখিও আসত এখানে। এখন এসব প্রায় অতীত বললেই চলে।
গাছপালা নিধন: চলতে চলতে আমাদের চোখে পড়ে কিছু কাটা গাছে গুড়ি। নদের ভাঙ্গনের কারণেই কেটে ফেলা হয়েছে এগুলো। এক সময় নদের পাড়ের এসব গ্রাম গাছপালা ও সবুজে-শ্যামলে শোভিত ছিল। নদীভাঙ্গন কবলিত হওয়ায় কেটে রাখা গাছগুলো বিক্রিও হবে নামমাত্র মূল্যে।
পানি দূষণ: এখন আর এসব এলাকায় ভাসমান পায়খানা পাওয়া যায় না। কিন্তু আজ থেকে ৪/৫ বছর আগে চিলমারীর নৌকা ঘাটে কিছু মানব কল্যাণে নিয়োজিত দেশি-বিদেশী সংস্থাকর্মীদের নৌকা থেকে পায়খানার লাইনটি নদের পানিতে ফেলার দৃশ্য দেখেছিলাম! এদের নিজস্ব নৌকায় নির্দিষ্ট রং ও লোগো ব্যবহার করা হত ফলে দূর থেকে সহজেই চেনা যেত।
আবার স্থানীয়দের কাছ থেকে কয়েক মাসের জন্য ভাড়া করা নৌকায় শুধুমাত্র সচেতনতামূলক নিশান ওড়ানো হয়। তবে এবারের ভ্রমণেও সেই পায়খানার দৃশ্য আমরা তুলতে সমর্থ হই। যারা সচেতন নয় তাদেরকে শেখাবো আমরা। কিন্তু সচেতনরাই যদি অসচেতনতার কাজ করি সচেতনতার কাজ করবে কে??
হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে এই নদটি চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে। পরবর্তীতে যমুনা নাম নিয়ে জামালপুর ও সিরাজগঞ্জের ভিতর দিয়ে চলে যায়। এটি ময়মনসিংহে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করে। নদের উজানে ভারত ও চীনের অসংখ্য বাঁধ থাকায় ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ভরাট হওয়ায় সামান্য পানিতেই বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এখন দরকার ড্রেজিং। সেই সাথে আন্তর্জাতিক ভাবে উজানের দেশ গুলোর সাথে পানি বন্টনসহ নদের গতিপথ ও নাব্যতা ঠিক রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে এ নদের অস্তিত্ব ধরে রাখা সম্ভব। তা নাহলে বৃহত্তম এই নদ একদিন ক্ষুদ্রতম খালের মর্যাদাও হারাবে।
বি:দ্র: উইকিপিডিয়ায় বাংলাদেশে নদটির প্রবেশের সীমান্ত হিসেবে ময়মনসিংহ লেখা হয়েছে। তবে সেটা ভুল।
লেখক- চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)