প্রজাপতি পার্ক ও এর রক্ষণাবেক্ষণ
শাওন চৌধুরী
‘প্রজাপতি’ শব্দটা শুনলেই মনের মধ্যে এক অপূর্ব সুন্দর অমেরুদন্ডী প্রাণির ছবি কল্পনার ক্যানভাসে ভেসে ওঠে, ফুলে ফুলে উড়ে মধু খেয়ে বেড়ানোই যার কাজ! এই মধু খেয়ে বেড়ানোর মাধ্যমে এরা প্রতিনিয়ত অগনিত ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে থাকে। অথচ আমাদের দেশে প্রজাপতির পার্ক করার জন্য প্রতিদিন শতশত প্রজাপতি ধরে নেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের ধারণা, এভাবে পূর্ণাংগ পুরুষ ও স্ত্রী প্রজাপতি ধরে কোথাও ছেড়ে দিলেই তারা মিলনে অংশ নিবে আর ডিম পাড়বে এবং প্রজাতির ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে!
প্রজাপতি খুবই সংবেদনশীল এক ধরণের প্রাণি, জীবনচক্রে একটু বাঁধা পড়লেই যারা কিনা আর টিকে থাকতে পারবে না! এদের জীবনচক্রে চারটি দশা থাকে- ডিম, ক্যাটারপিলার, পিউপা ও পরিণত সদস্য। স্ত্রী সদস্য মিলনের পরে যখন ডিম পাড়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখন নির্দিষ্ট সীমানাতে ঘুরে ঘুরে এমন ধরণের উদ্ভিদ খুঁজতে থাকে যেটা খেয়ে ক্যাটারপিলার বেঁচে থাকতে পারে, এই উদ্ভিদগুলোকে হোস্টপ্লান্ট বলে। উল্লেখ্য যে প্রতিটি প্রজাপতির জন্য হোস্টপ্লান্ট নির্দিষ্ট এবং ঐ নির্দিষ্ট উদ্ভিদ ছাড়া এরা এদের বংশধারা বজায় রাখতে পারেনা।
ক্যাটারপিলার অবস্থাতে যদি কোন মানুষ বা অন্য কোন প্রাণি তাকে স্পর্শ করে তাহলে তার বৃদ্ধির হার ব্যহত হবে এবং সে স্বাভাবিক আকারপ্রাপ্ত হবেনা। পিউপা থেকে যখন পূর্ণাংগ প্রজাপতি বের হয় তখন একটা স্বাভাবিক ও সুন্দর পরিবেশের প্রয়োজন পড়ে। পিউপা থেকে বের হবার পরে এদের কিছুসময় বিশ্রামের প্রয়োজন পড়ে কারণ এদের পাখাগুলো ঐ সময় ভেজা থাকে আর ঐ অবস্থাতে এরা উড়তে পারেনা। পাখা শুকানোর জন্য এরা স্থির হয়ে কোনকিছুর ওপরে বসে থাকে। এই অবস্থাতে যদি এরা কোন কিছু দ্বারা বাঁধাপ্রাপ্ত হয় তাহলে এদের অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে প্রজাপতির পার্ক করা হচ্ছে, মূলত প্রজাপতির অকৃত্রিম সৌন্দর্য সবার সামনে উপস্থাপনের জন্যই এমন মহান সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আর এজন্যই এরা কিছু লোক ঠিক করেছে যারা কিনা ‘সুইপিং নেট’ নিয়ে বিভিন্ন বাগান কিংবা বনে ঘুরে প্রজাপতি সংগ্রহ করছে। মজার বিষয় হচ্ছে যে, যাদেরকে এসব কাজে নিয়োগ করা হয়েছে প্রজাপতি সম্পর্কে এদের সামান্যতম ধারণাও নেই। আমার মনে হয় এরা এটাও জানেনা যে প্রজাপতি কোন বর্গভুক্ত!
সময় পেলেই আমরা মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে প্রজাপতি দেখতে যাই। মাঝেমধ্যেই দেখতে পাই যে একদল গ্রুপ ‘সুইপিং নেট’ এর সাহায্যে দেদারসে প্রজাপতি ধরছে আর বাক্সে বন্দী করে রাখছে! মজার বিষয় হচ্ছে, এরা সামনে মথ দেখলে সেটাও ধরে রাখছে কারণ এরা প্রজাপতি আর মথের মধ্যকার পার্থক্যইতো জানেন না! আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি যে, গাজীপুর সাফারি পার্কে যে প্রজাপ্রতি বাগান করা হয়েছে সেখান থেকে তাঁরা এসেছেন। এখন পাঠকের মনে নিশ্চয় প্রশ্ন এসেছে যে কোথা থেকে আমরা তথ্য গ্রহণ করেছি!! আসলে ঐ লোকগুলোর কাছথেকেই জানতে পেরেছি যে তাঁরা ঐখান থেকেই এসেছেন। আবার তাঁরা নাকি ঐখানে কৃত্রিম প্রজননও করেন! অনেকের মনে এমনটাও প্রশ্ন হতে পারে যে এমন করলে ক্ষতি কী, অন্যরা তো সুন্দরভাবে দেখতে পাবে আবার এরাও মিলনে অংশ নিবে এবং প্রজাতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে! আপনাদের ভূল ভাঙানোর জন্য কিছু কথা আগে থেকে বলে দেই…
প্রতিটা প্রজাপতি কিংবা অন্য যেকোন প্রাণি একটা নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হতে অভ্যস্ত, হঠাৎ করে এদেরকে অন্য অপরিচিত পরিবেশে ছেড়ে দিলে এরা বাঁচতে পারেনা। প্রতিটা পরিবেশে টিকে থাকার জন্য এদের নির্দিষ্ট জেনেটিক ম্যাপ থাকে যার কারণে একই প্রজাতির হওয়া সত্ত্বেও সমতল ভূমিতে থাকা প্রজাপতির সাথে পাহাড়ি অঞ্চলে থাকা প্রজাপতির কোন মিল পাওয়া যাবেনা। এরা যেখানে থাকে সেখানে এদের নির্দিষ্ট সীমানা থাকে যার বাইরে এরা সাধারণত যায়না। নির্দিষ্ট সীমানা থাকার কারণে মেটিং থেকে শুরু করে পূর্ণাংগ প্রজাপতি হওয়া পর্যন্ত জীবনচক্রের সকল দশাই ঐ নির্দিষ্ট পরিবেশে হয়। এখন যদি শালবনে পাওয়া প্রজাপতিগুলোকে এমন একটা বদ্ধ স্থানে রাখা হয় যেখানে গুটিকয়েক শাল গাছ আছে, সেখানে কি ওরা বাঁচবে? কিংবা পাহাড়ি অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রজাপতিগুলোকে নতুন স্থানে নিয়ে গেলে ওরা কি আসলেই বাঁচতে পারবে!
একটু ভাল করে দেখলেই দেখা যাবে যে স্ত্রী প্রজাপতির পেছনে পুরুষ প্রজাপতি নির্দিষ্ট ছন্দে ছুটছে। এই ধরণের বৈশিষ্ট্যকে ‘কোর্টশিপ’ বলে, স্ত্রী সদস্যকে মেটিং এ আহ্বানের জন্যই পুরুষ সদস্য তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করে। যেকোন পুরুষ সদস্যই যদি স্ত্রী সদস্যের পেছনে এমনভাবে ঘুরে ঘুরে তার সাথে মিলনে অংশ নিতে চায় তাহলে কিন্তু হবেনা, ঐ পুরুষ সদস্যকে যদি স্ত্রী সদস্যটির পছন্দ হয়, তাহলেই সে মিলনে অংশ নিবে অন্যথায় নয়।
একটা প্রজাপতি মিলনের পরে যখন ডিম পাড়বে তখন একটা নির্দিষ্ট হোস্টপ্লান্টের প্রয়োজন পড়ে, ঐ নির্দিষ্ট উদ্ভিদটি ছাড়া জীবনচক্রের সকল দশা সম্পন্ন হবেনা। তাই কেও যদি কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এদের বংশবৃদ্ধি করতে চায় তাহলে ঐখানে অবশ্যই নির্দিষ্ট হোস্টপ্লান্ট রাখতে হবে, এছাড়া যতো যা-ই করা হোক না কেন, এদেরকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবেনা। ক্যাটারপিলার থেকে যখন পিউপা হবে তখন এরা পাতার নিচের অংশে থাকে এবং এসময়ে এরা বেশি আলো পছন্দ করেনা যার কারণে কৃত্রিমভাবে কিছু করতে হলে ঐ সময়ে নির্দিষ্ট আলোর ব্যবস্থা থাকতে হবে।
যারা জীবনে সুইপিং নেট ব্যবহার করেন নি তাঁরা ঠিক বুঝতে পারবেন না যে এটা দিয়ে ধরার ফলে প্রজাপতির কতোটা ক্ষতি হয়! লেপিডপ্টেরা বর্গের প্রধান বৈশিষ্ঠ হচ্ছে এদের গায়ে স্কেল থাকে, কখনো প্রজাপতিকে ধরে থাকলে দেখবেন হাতে একধরনের গুঁড়া লেগে গেছে, এগুলোই হচ্ছে এদের স্কেল। ঐ নেটের সাহায্যে ধরার ফলে এদের স্কেলের অনেক ক্ষতি হয় যার কারণে বেশিরভাগের পক্ষেই বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না। আর সুইপিং নেট ভালভাবে হ্যান্ডেল করতে না পারলে পাখা ভেঙে যায় আর পাখা ভাঙলে এরা বেশিদিন বাঁচতে পারেনা। আর স্কেল নষ্ট হলে কিংবা পাখা ভেঙে গেলে যখন মেটিং এর সময়ে আরেকজনকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করবে তখন কোন লাভই হবেনা।
একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে যে, যাদেরকে দিয়ে এসব প্রজাপতি সংগ্রহ করা হচ্ছে তাদের বেশিরভাগেরই প্রজাপতি সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও নেই যার কারণে এরা বুঝতেই পারছে না যে কি ধরে নিয়ে যাচ্ছে! কোন ধারণা না থাকার কারণে এরা প্রকৃতির যে কতো বড় ক্ষতি করে ফেলছে এটা তাঁরা নিজেরাও জানেন না। বাংলাদেশে প্রজাপতির অবস্থা নিয়ে কাজ করা হয়নি বললেই চলে। সম্প্রতি জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মনোয়ার হোসেন তুহিন স্যার আই.ইউ.সি.এন. এর সহায়তায় বাংলাদেশের প্রজাপতির অবস্থা সম্পর্কে একটা প্রজেক্টের সাথে যুক্ত আছেন। আর বাংলাদেশের প্রজাপতি নিয়ে একটা চেকলিস্ট করা হয়েছিল যার কারণে এদেশে এমন অনেক প্রজাতির প্রজাপতি রয়েছে যা কিনা লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে।
মনে করুন, এসব লোকের সামনে দিয়ে ঐ নতুন প্রজাতি কিংবা সেসব প্রজাতি ধরা পড়ল যাদের অবস্থা বাংলাদেশে শংকাকুল কিংবা বিপন্নপ্রায়, তাহলে কী হবে! এরকম চলতে থাকলে কিছুদিন পরে তো প্রজাপতি খোঁজার জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে ঘুরতে হবে! প্রজাপতির জীবনচক্র, হোস্টপ্লান্ট, কোর্টশিপ, মেটিং কিংবা আর যা যা আছে তা সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা ছাড়াতো এরকম করে কৃত্রিম প্রজনন করানো একেবারেই ঠিক নয়।
জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে কৃত্রিম প্রজনন করানো হয় কিন্তু এখানে কখনো একস্থানের প্রজাপতি ধরে অন্য আরেক এনে কিছু করা হয়না বরং প্রাকৃতিক ভাবেই সবকাজ করা হয়। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এম. এ. বাশার স্যার গাজীপুরের ভাওয়ালে একটি প্রজাপতির বাগান করেছেন যা কিনা বাংলাদেশের একমাত্র মুক্ত প্রজাপতির বাগান।
কৃত্রিমভাবে প্রজনন ঘটিয়ে প্রজাপতির সংখ্যা বৃদ্ধি করা নিঃসন্দেহে অনেক প্রশংসনীয় কাজ কিন্তু তা করার জন্য অবশ্যই অনেক নিয়ম-কানুন অনুসরণ করতে হবে। যেমন, বাগানে বিভিন্ন স্তরের উদ্ভিদ থাকতে হবে যাতে করে বিভিন্ন স্তরে থাকা প্রজাপতি ঠিক মতোন থাকতে পারে, বাগান যতোটা সম্ভব খোলামেলা রাখতে হবে যাতে করে প্রজাপতিগুলো মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারে, অনেক স্বেচ্ছাসেবকের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে করে তাঁরা খেয়াল রাখেন যে, কোন দর্শক বাগানের কোন কিছুর ক্ষতি করছে কিনা বিশেষ করে কোন গাছ পাড়াচ্ছে কিনা, যারা প্রজাপতি সংগ্রহ করবে তাঁদেরকে অবশ্যই প্রজাপতিগুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ জ্ঞান থাকতে হবে যাতে করে তাঁরা দেখলেই ঐ প্রজাপতিটির ঐ অঞ্চলের কিংবা দেশের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবে, পূর্ণাংগ প্রজাপতি সংগ্রহ না করে ডিম বা ক্যাটারপিলার আনা অনেক বেশি ফলপ্রসূ ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও দায়িত্বে থাকা কমিটির অবশ্যই ঐ বাগানে এমন লোক রাখতে হবে যারা কিনা ঐসব প্রজাপতি সম্পর্কে দর্শকদেরকে ধারণা দিতে পারবেন এবং জীববৈচিত্র ও সংরক্ষণের নানান দিক সম্পর্কেও পরিস্কার ধারণা থাকতে হবে।
প্রজাপতি পরিবেশের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। ফুলের পরাগায়ন থেকে শুরু করে বাস্তুতন্ত্রের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রজাপতির সংখ্যা দ্বারাই বোঝা যায় যে একটি বনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ঠিক-ঠাক আছে কিনা! এজন্য অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, প্রজাপতিকে অন্যের কাছে আকর্ষণের বিষয়বস্তু করার জন্য আমরা যেন এদেরকে প্রকৃতি থেকে হারিয়েই না ফেলি! তাই প্রজাপতি পার্ক করতে হলে অবশ্যই নির্দিষ্ট নিয়মকানুন মেনে সবকিছু করতে হবে এবং রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন হতে হবে, অন্যথায় এমন সুন্দর সৃষ্টিকে আর বেশিদিন ধরে রাখা যাবেনা।