'ক্যামেরাস ফর কনজারভেশন'; স্বপ্নের পথে এক ধাপ !
ফারজানা হালিম নির্জন
‘বিশ্বাস’; মনস্তাত্ত্বিক এই অনুভূতিটির জোর অনেক বেশি। সুন্দর একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠার পেছনে মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে অগাধ বিশ্বাস। বন্যপ্রাণি রক্ষার্থে বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের সাহসী এবং মহৎ উদ্যোগের কথা নিশ্চয়ই সকলের জানা! প্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার সিজার রাহমান চমৎকার একটি পরিকল্পনা প্রায় এক বছর ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, যার মূল ভিত্তি বিশ্বাস বা আস্থা স্থাপন। আর তাঁদের গবেষণাধর্মী কাজেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বা পরিকল্পনা, যাই বলুন না কেন, তা হচ্ছে ‘ক্যামেরাস ফর কনজারভেশন’। প্রশ্ন হচ্ছে এর সাথে বিশ্বাসের কী সম্পর্ক? বলছি…
‘ক্যামেরাস ফর কনজারভেশন’ একটি মস্ত বড় পরিকল্পনার প্রাথমিক পর্যায়। সেই পরিকল্পনাটি হচ্ছে বন্য প্রাণি শিকার বন্ধ করা। বাংলাদেশে ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট নামক অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম একটু একটু করে শুরু হয়। তখন থেকেই শাহরিয়ার সিজার ঢাকা-পার্বত্য চট্টগ্রাম-লাউয়াছড়া-ঢাকা এইভাবে ছোটাছুটি করতে থাকেন তাঁর গবেষক দলের সাথে। এখনো ছোটাছুটির মধ্যেই আছেন! উদ্দেশ্য ছিলো শুধুমাত্র বিপন্ন সরীসৃপ রক্ষা করা। অজগর দিয়েই ছিলো সেই স্বপ্নযাত্রার সূচনা। তারপর যুক্ত হলো কচ্ছপ। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় আর লাউয়াছড়ার বিস্তীর্ণ জঙ্গলে ঘুরাঘুরি করতে করতে তাঁরা একসময় উপলব্ধি করলেন, ‘বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট’ -এই আর সীমাবদ্ধ থাকা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশে বহু বন্য প্রাণি অযত্নে-অবহেলায় কোনোরকম বেঁচে আছে। হয়তো নির্দিষ্ট কোনো তালিকাও নেই তাদের। একজন প্রকৃত বন্যপ্রাণি গবেষক কিংবা প্রকৃতিপ্রেমীর চোখ কখনো তা এড়িয়ে যেতে পারেনা। কাজেই, তাঁদের কাজের পরিধি আরো বেড়ে গেলো। আপাতত প্রধান উদ্দেশ্য গিয়ে স্থির হলো বিপন্ন সরীসৃপ, উভচর রক্ষা করা এবং একই সাথে বন্যপ্রাণি শিকার বন্ধ করা। সেই লক্ষ্যে ২০১৪ সালে ‘ক্যামেরাস ফর কনজারভেশন’ এর যাত্রা শুরু হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় অর্থাৎ গভীর জঙ্গল এবং পাহাড়ি পরিবেশে আদিবাসীদের বসতি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। জায়গাগুলো এতোটাই প্রত্যন্ত, যেখানে হয়তো মনুষ্য বসবাস কল্পনাও করা যায় না। কিছু কিছু জায়গা বন্যপ্রাণিদের বসবাসের জন্য চিহ্নিত করা আছে। কিন্তু আদিবাসীদের জীবন বহু বছর ধরে এই পরিবেশের সাথেই মিলে-মিশে গেছে। বেঁচে থাকার তাগিদে তাঁরা নিজেদের মত করে নানা পথ বের করে নিয়েছেন। সেখানে কোনো বাজার নেই, মৌসুম ছাড়া কোনো শাক-সবজি, ফল-মূল পাওয়া যায় না। তাঁরা পাহাড়ে জুম চাষ করে, নয়তো পাহাড়ি ছড়া থেকে মাছ ধরে, এইসব করেই তাঁদের খাবারের চাহিদা মেটাতে হয়। কন্তু সবকিছুই ভাগ্য এবং মৌসুম নির্ভর। কাজেই বন্য পরিবেশে বন্য কোনো প্রাণি দেখা মাত্রই তাঁরা শিকার করে ফেলে। এটাও তাঁদের একপ্রকার খাবারের উৎস। হয়তো ছোটো একটা কচ্ছপের বাচ্চা শিকার করে খেয়ে ফেললো, এতে যে খুব বেশি ক্ষুধা নিবারণ হচ্ছে, তা নয়, কিন্তু শিকারের এই অভ্যাসটাই তাঁদের রক্তে মিশে গেছে! তো, তাঁদের হাতে ক্যামেরা দেয়ার আগ পর্যন্ত গবেষক দলকে আদিবাসীরা নানা রকম অদ্ভুত, অস্বাভাবিক প্রাণির কথা বলতেন, মৃত প্রাণি পাওয়া গেলে সে কথাও বলতেন। কিন্তু নির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকার কারণে গবেষকদলের শুনে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলোনা। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের মুরং পাড়ার ক’জন আদিবাসীদের হাতে কিছু ক্যামেরা তুলে দেয়া হলো ২০১৪ সালের শেষের দিকে। তাঁদেরকে বলা হয়েছে যেকোনো প্রাণির সন্ধান পেলেই ছবি তুলে ফেলতে। তাঁরা আগ্রহের সাথে এখন ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলছে্ন। আর এইসব ছবি থেকেই উদ্ধার হচ্ছে অনেক অজানা তথ্য!
গবেষক দল নতুন করে তালিকা ভুক্ত করছেন, চমকে যাওয়ার মত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেড়িয়ে আসছে মুরং আদিবাসীদের তোলা ছবি থেকে। সেইসব আদিবাসী আলোকচিত্রীরা যে শুধু প্রাণির ছবিই তুলে যাচ্ছেন , তা কিন্তু নয়! তাঁরা নিজেদেরে ছবি তুলছেন, প্রিয় মানুষের ছবি তুলছেন! দারুণ আনন্দে ছবি তুলে যাচ্ছেন যেকোনো কিছুর, যা তাঁদের চোখে ভালো লাগে! শুরুতে একজন না-কি ক্যামেরা নষ্ট হয়ে যাবার ভয়ে ছবিই তুলতেন না! তারপর শাহরিয়ার সিজার তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, ক্যামেরা নষ্ট হয়ে গেলে কোনো সমস্যা নেই, তিনি নির্দ্বিধায় ছবি তুলতে পারেন! ভয় কাটিয়ে এখন তিনিও ছবি তুলছেন। আর এইসব দায়িত্ববান আদিবাসীদের নাম দেয়া হয়েছে ‘ইকো-গার্ডিয়ান’ !
বিশ্বাস কথাটির প্রসংগ কেন শুরুতে আনা হলো? বন্যপ্রাণি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবার পেছনে মূলত সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আদিবাসীরা তা শিকার করছেন নিয়মিত! শিকারের সাথে তাঁদের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। একপ্রকার তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতির অংশ হয়ে গিয়েছে এটি। যখন থেকে তাঁরা এইসব পাহাড়ি অরণ্যে বসবাস শুরু করেন তখন থেকেই তাঁরা খাবারের সন্ধানে এই রূঢ়তম বাস্তবতার সাথে জড়িয়ে গিয়েছে। শাহরিয়ার সিজার বুঝতে পেরেছেন, আদিবাসীদের এই চিরাচরিত সংস্কৃতি থেকে এক নিমিষেই বের করে আনা কিছুতেই সম্ভব না! হুট করে যেয়ে যদি তাঁদের শিকার বন্ধ করার কথা বলা হয়, তাঁরা কিছুতেই তাতে রাজী হবেন না। আর তাঁদের সহায়তা ছাড়াও এই কাজে অগ্রসর হওয়া অর্থহীন। তাছাড়া সেইসব প্রত্যন্ত এলাকার আদিবাসীদের জীবন, চেতনা, দর্শন সবকিছু এখনো গভীর অরণ্যের মতই রয়ে গেছে, সেখানে শিক্ষার ছোঁয়া নেই, নেই আধুনিক সভ্যতার কোনো চিহ্ণ। তাই বন্যপ্রাণি রক্ষার্থে শিকার বন্ধ করার মত এই গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যম্ভাবি কাজটি চট করেই করে ফেলা সম্ভব নয়! শাহরিয়ার সিজার ২০১১ সাল থেকে তাঁদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করছেন, আন্তরিকতায় তাঁদের সাথে একটু একটু করে সম্পর্ক গড়ে তুলছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, এই মহৎ কাজের পরিপূর্ণতার জন্য পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আনাটা সবার আগে জরুরি। একজন শিশুকে পরম ভালোবাসায় সিক্ত করে, যখন তাকে খুব বড়দের একটি কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়, শিশুটি বুঝতে পারে; তাকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, এবং নানাভাবে সে তার পরিশ্রমের মাধ্যমে সেই কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে চেষ্টা করে। আদিবাসীরাতো অনেকটা শিশুর মতই! তাঁরা সহজ-সরল, তাঁদেরকে যখন বন্ধুর মত কাছে টেনে নেয়া হলো, তাঁদের মাঝে কেউ কেউ প্রতিজ্ঞা করলেন আর কখনো শিকার করবেন না, বরং উলটো্ আগ্রহের সাথে শাহরিয়ার সিজার-এর গবেষক দলের সাথে সময় কাটাতে শুরু করলেন, নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে লাগলেন। শাহরিয়ার সিজার মাঝে মাঝে সেইসব বদলে যাওয়া আদিবাসীদের ছবি প্রিন্ট করে বাঁধাই করে তাঁদের হাতে তুলে দেন। অপার বিস্ময়ে, মুগ্ধ হয়ে তাঁরা নিজেদের ছবি, প্রিয় মানুষের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন! মানুষকে কাছে টেনে নেয়া আর আপন করে নেয়ার জন্য কি খুব বেশি কিছুর দরকার হয় আসলেই?
প্রাথমিকভাবে ‘দ্যা বায়োডাইভার্সিটি গ্রুপ’ নামক আন্তর্জাতিক প্রাণি গবেষক এবং আলোকচিত্রীদের একটি দল বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, ৫ টি ক্যামেরা প্রদান করেন। এর মধ্যে ৪ টি পার্বত্য চট্টগ্রামের ৪ গ্রামের ৪ জন আগ্রহী আদিবাসীর হাতে হস্তান্তর করা হয় এবং ১ টি লাউয়াছড়ায় দেয়া হয়।
এই তো কিছুদিনের মধ্যে আরো ৫ টি ক্যামেরা আরো ৫ জন আদিবাসীর হাতে তুলে দেয়া হবে। শাহরিয়ার সিজারের পরিকল্পনার আরেকটি অংশ হচ্ছে, আদিবাসীদের মধ্যেই নেতৃত্বের গুণাবলী স্থাপন করা। একজন আদর্শ তৈরি করে বাকিদের সামনে তুলে ধরা। যখন অন্য তরুণরা দেখছেন, তাঁরই বয়সী একজনের এখন একটি নিজস্ব ক্যামেরা আছে, যা নিয়ে তিনি ছবি তুলছেন এবং স্যাঁতস্যাঁতে জীবনে অনেকখানি পরিবর্তন আসছে, তিনি আর হিংস্রভাবে বন্য প্রাণি শিকার করছেননা বরং অন্য উপায়ে বেশ ভালো আছেন! তখন সেই তরুণটির মধ্যেও একটু পরিবর্তন আসতে থাকে, তিনিও মনে মনে ভাবেন, ইশ, তিনিও যদি তাঁর বন্ধুটির মত হতে পারতেন, যিনি অন্যদের থেকে একেবারেই আলাদা! এবং এই ব্যাপারটিই এখন হচ্ছে! যার জন্যই নতুন আরো ৫ জনকে ৫ টি ক্যামেরা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
বিগত এক বছরে ‘ক্যামেরাস ফর কনজারভেশন’ এর সুবাদে, আদিবাসী আলোকচিত্রীদের ক্যামেরায় যেসব মূল্যবান ছবি উঠে এসেছে, সেগুলোর একাংশ নিচে দেয়া হলো-
‘ক্যামেরাস ফর কনজারভেশন’ আর কতদিন চলবে? –এই প্রশ্নের উত্তরে শাহরিয়ার সিজার রাহমান বললেন, নির্দিষ্টভাবে সীমারেখা টানা সম্ভব নয়। যদিও বন্যপ্রাণি শিকার বন্ধ করার মত বিশাল এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার একেবারেই প্রাথমিক পর্যায় এটি, এবং এর উপর ভিত্তি করে আরো কিছু প্রকল্পে হাত দেয়া হয়েছে, তবুও ‘ক্যামেরাস ফর কনজারভেশন’ চলতেই থাকবে।
‘ক্রাফটস ফর কনজারভেশন’, ‘স্কুলস ফর কনজারভেশন’ এই প্রজেক্টগুলো কিন্তু ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে! যা আদিবাসীদের জন্য এবং একই সাথে মূল উদ্দেশ্য সফল করার লক্ষ্যে এক বিরাট অবদান রাখতে যাচ্ছে। কিন্তু জিনিসগুলো কী? শাহরিয়ার সিজার হাসলেন, যে হাসির মাঝেই স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিলো একজন স্বপ্নবাজ মানুষের স্বপ্ন পূরণের তীব্র আকাংক্ষা। জানবো সে সম্পর্কে, জানাবো সেই স্বপ্নের কথা। সাথে থাকুন, আর বন্য প্রাণিদের রক্ষার জন্য নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হোন যতটুকু পারা যায়! সবটাই কি বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্টের গবেষকদল আর আদিবাসীরাই সম্পন্ন করবেন? শহরে বাস করেও তো আমাদের অনেক কিছু করার আছে!
বাংলাদেশ পাইথন প্রজেক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন।