
গাম্ভীর্যে অনন্য চিম্বুক; কবে যাবো পাহাড়ে, আহারে !
ফারজানা হালিম নির্জন
পাহাড়-ঘেরা সবুজের জেলা বান্দরবান। বাংলাদেশের মোট তিনটি পার্বত্য জেলার মধ্যে একটি, এই বান্দরবান। আর সেই সাথে একে বলা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে কম জনবসতিসম্পন্ন স্থান। চট্টগ্রাম থেকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের ঝাপি খুলে বসে আছে এই জেলা। কিছুদিন আগে দেখতে গিয়েছিলাম সেই পাহাড়-সম্রাটকে। নাগরিক চাঞ্চল্যতা এড়িয়ে কিছুদূর এগোনোর পরই পাহাড়ের অন্যরকম এক মায়াময় ইশারা কেমন যেন হাতছানি দিয়ে কাছে টানতে থাকে। সেই ডাক উপেক্ষা করা একেবারেই অসম্ভব। ছোট-বড় বিভিন্ন টিলা আর পাহাড়ের গাম্ভীর্য-ভরা সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে হতে কত শত বাঁক পেড়িয়ে গিয়েছি! মনে হচ্ছিলো,এক একটি মোড় পেড়োচ্ছি আর রূপকথার কোনো বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছি। নতুন এক কাহিনী হাজির হচ্ছে চোখের সামনে। নৈঃশব্দের অরণ্যে চোখ ভরে দেখে গেছি সেই অবাক দৃশ্য,একের পর এক।
হঠাৎ বড়-সড়ো একটি বাঁক ঘুরতেই, চোখে পড়লো একটি ছোট-খাটো বাজার। ঠিক মফস্বল শহরের মত নয়,আবার বড় শহরের মতও নয়! বাঙ্গালি দেখতে পাবো কি না,এই ধরণের একটি ক্ষীণ সন্দেহ ছিলো মনের ভেতর। কিন্তু তা একেবারে ভুল প্রমাণিত হলো। শহরের এই ছোট্ট পরিসীমার ভেতর ছোট ছোট টিলা যেমন আছে, তেমনি পর্যটকদের সাদরে গ্রহণ করবার জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরণের বড় বড় হোটেল। বান্দরবান সদর খুব ছোট্ট এলাকা। কিন্তু ছবির মত এই ছোট্ট সদরে এক রাত কাটালেই টের পাওয়া যায়, মায়াকাড়া বান্দরবান জেলায় সৌন্দর্যের পরিধি অনেক বড়! নিঝুম অন্ধকারে পিচ-ঢালা নীরব রাস্তায় একরাতেই কতবার হেঁটে গেছি, তার হিসেব কষা হয়নি। রাস্তার পাশে আধুনিকতার ছোঁয়ায় তৈরি করা রেঁস্তোরা,বান্দরবানের ঐতিহ্যবাহী জিনিস-পাতির দোকান,আবার কখনো ছোট-খাটো কাঁচা-বাজার,সবকিছু মিলিয়ে অসাধারণ এক সদর-রাজ্য, বান্দরবান।
বান্দরবানের রূপ-বৈচিত্র্য নিয়ে কখনো পরিপূর্ণ লেখনী লেখা হয়তো সম্ভব নয় । নীলগিরির নীলের মায়া, নীলাচলের স্নিগ্ধতা, সাঙ্গু নদীর শীতল জলধারার গল্প, বগা লেকের অপার্থিব সৌন্দর্যের আঘাত যে কী পরিমাণ তীক্ষ্ণ, তা হয়তো চোখে দেখা আর উপলব্ধি করার জন্যই কেবল তৈরি। তবু একটু বৃথা চেষ্টা করছি রূপবান এক পাহাড়ের গল্প লিখতে। নীলগিরি কিংবা নীলাচল নিয়ে লেখার সাহস পাচ্ছিনা। তাঁরা নাহয় থাক তাঁদের মহীয়ান সৌন্দর্যের টোঁপর পড়ে। লিখছি আমার চোখে অনন্য,অন্য এক রূপবানের গল্প। ছোট্ট কিন্তু বিশালতায় যে সেরা, শান্ত কিন্তু পৌরুষত্বের গাম্ভীর্যে যে পরিপূর্ণ, সকলের অগোচরেই যে মেঘ-বৃষ্টির সাথে সুখ-দুঃখের নিবিড় গল্প করে যায় প্রতিরাতে। নীলগিরি যাওয়ার পথে, বান্দরবান সদর থেকে মাত্র ২৬ কিঃমিঃ দূরেই সবুজের আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সেই পাহাড়টি, চিম্বুক।
‘বাংলার দার্জিলিং’ খ্যাত সেই চুম্বকের আকর্ষণে আঁকা-বাঁকা পথকে আলিঙ্গন করে যাত্রা শুরু করেছিলাম নীল রঙ্গা জিপ গাড়িতে। যাত্রাপথের চমৎকার দৃশ্য বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলো,আমি পৃথিবীতে নেই। স্বর্গ বুঝি এমনই দেখতে?
পথের ধারে মাঝে মাঝেই আদিবাসীদের ঘর-বাড়ি, চা-য়ের দোকান, ওঁদের নিজস্ব ঢঙ্গে সাজানো হোটেল আর চোখটাকে আরো একটু দূরে নিলে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। সবুজ আর নীলের মিশেলে প্রকৃতির এই মায়াময় রূপ দেখতে দেখতে গভীর এক আনন্দে যেন ডুবে ছিলাম। ২৬ কিঃমি পথের পুরোটা জুড়ে এমনই ভাবে বাস্তবতা থেকে হারিয়ে অন্য এক জগতে সৌন্দর্যের অপার মমতায় দোল খাচ্ছিলাম। সৃষ্টিকর্তার কী অপূর্ব সৃষ্টি এই আমাদের পৃথিবী! মাঝে মাঝেই আদিবাসী শিশুদের দেখা যাচ্ছিলো স্কুলের পোশাকে দল-বেঁধে হেঁটে যাচ্ছে, কখনো বা ঝুঁড়ি কাঁধে আদিবাসী কিশোরীরা আমাদের থেকেও অনেক খানি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমাদের দিকে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু এই পথের সৌন্দর্য লিখতে থাকলে আস্ত একটা উপন্যাসই হয়ে যাবে হয়তো! এই পথ জুড়েই যে কত গল্প আর কত মায়া! আঁকাবাঁকা পথের বাঁক ঘুরতে ঘুরতে আর সেই সাথে চাপা রহস্য উন্মোচিত করতে করতেই মুহুর্তগুলো কেটে যাচ্ছিলো নিস্তব্ধতায়…
পথের ধারের ‘দাঁড়োয়ান-ফলক’ একটু পর পর জানিয়ে দিচ্ছে, আর কতদূর চিম্বুক! ২০,১০,৩,২,১ কিঃমিঃ…অবশেষে পেলাম তাঁর দেখা। সর্বশেষ দাড়োয়ান-ফলকটি নিচ থেকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে দেখিয়ে দিলো,এই পথেই উঠতে হবে চিম্বুকের গা বেয়ে একেবারে চূড়ায়। অসম্ভব রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি নিয়ে ধীরে ধীরে এগুচ্ছি, আর অদ্ভুত এক পাহাড়ি শব্দে হারিয়ে যাচ্ছে মন-প্রাণ। প্রকৃতির বিশালতায় মিশে গেলে নিজেকে প্রথম প্রথম খুব ক্ষুদ্র আর তুচ্ছ মনে হয়, কিন্তু প্রকৃতি যখন আস্তে আস্তে তার বিশালতা দিয়ে মনের সমস্ত হাহাকার কেড়ে নেয়, তখন মনে হয় উদারতা আমার ভেতরও কী অদ্ভুতভাবে বাসা বেঁধে ফেলেছে! অনেক-খানি পথ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে হেঁটে পাড়ি দিলাম। তারপর হঠাৎ মোড় ঘুরতেই কাঠ-বাঁশের তৈরি এক আলিসান স্বাপ্নিক বাড়ি যেন স্বাগত জানালো নতজানু হয়ে।
পাহাড়ের পেছন দিকের কাশফুলের সারি আর নাম না জানা অসংখ্য বুনো ফুলের বাগানও একই সাথে অভ্যর্থনা জানাবে, যদি আপনিও যান সেখানে। ছবির মত সুন্দর এই পাহাড়টিতে সে অর্থে দেখার মত হয়তো নেই আর কিছু, কিন্তু আছে আরো অনেক কিছু! তা দেখতে হলে খুলে দিতে হবে হৃদয়ের চোখ। পাহাড়ের উপর থেকে মাঝে মাঝে নাকি হাত দিয়ে মেঘও ছুঁয়ে দেয়া যায়। আর দূরের আবছা আবছা ঐ সাঙ্গু নদীর নীরবে বয়ে চলার দৃশ্য মনকে নিয়ে যাবে তারই সাথে করে অনেক দূর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫০০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন এই চিম্বুক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালে, এক নিমিষেই যেন জীবনের সমস্ত হিসেব-নিকেশ চুকে যায়। পৃথিবী কত সুন্দর,কত সুন্দর আমাদের দেশ ! পাহাড়ের আলিঙ্গনে আর সবুজের ফাঁকে বিশাল নীল-আকাশটাকে আরো একটু কাছের মনে হয়। হাত দিয়ে আলতো স্পর্শ করলেই যেনো গাম্ভীর্য ভেঙ্গে জেগে উঠবে চিম্বুক পাহাড়। তখন আর জাগাতে ইচ্ছে হয়না তাকে। থাকুক সে এভাবেই। এতেই তাঁর রূপ লুকিয়ে আছে।
চিম্বুকের স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, এখানে সুপেয় পানির একটু অপ্রতুলতা আছে। তবে থাকা-খাওয়ার জন্য রেস্ট হাউজ আছে দু’টি। ইচ্ছে করলেই আগে থেকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে থাকা যায় এখানে। আর চিম্বুকে প্রবেশ করার মুখেই মিলিটারি চেক-পোস্টে নাম-ঠিকানা নিবন্ধন করে যেতে হয়। সুপেয় পানির অভাবটি না থাকলে হয়তো পর্যটকদের কাছে খুব সহজেই পোঁছে যেতে পারতো এই দর্শনীয় স্থানটি। সেসব কথা ভাবতে ভাবতেই, চিম্বুকের চূড়ায় হাওয়ার দোল লাগিয়ে গেলো যেন কেউ। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু সে দৃশ্য যে কত মায়াকাড়া হতে পারে, তা কিছু মুহুর্ত কাটিয়েই বেশ বুঝে গিয়েছিলাম। সময়ের নিষ্ঠুর তাড়াহুড়োয় ফেলে আসতে হলো এই স্বপ্ন-রাজ পাহাড়কে। চিম্বুক তাঁরই মত গাম্ভীর্য নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত এক টান আর মায়া মনের ভিতর প্রতীজ্ঞা-লিপি লিখে নিলো যেন, আবার দেখা হবে, হতেই হবে…