পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি বিবেচনায় পলিথিন নিষিদ্ধের আইন কার্যকর করার দাবি

বাংলাদেশে পলিথিন ও পলিথিনজাত দ্রব্যসামগ্রীর ব্যাপক ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। অপরদিকে পরিবেশবান্ধব পাটজাত দ্রব্যের বহুল ব্যবহার ও প্রাপ্তি সহজলভ্য করতে সরকারি অবহেলায় আমাদের সোনালী আঁশ  দিন দিন মার খাচ্ছে। পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি রক্ষায় পলিথিন নিষিদ্ধের আইন দ্রুত কার্যকর করতে হবে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন পবাসহ ১৭ টি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪, শুক্রবার, সকাল ১১টায় কাওরানবাজারে এক মানববন্ধনে উক্ত দাবী জানানো হয়।

বক্তারা বলেন, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসেবে প্রতিদিন এক কোটির বেশী পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। এগুলো দ্বারা ড্রেন, নালা, খাল, ডোবা ইত্যাদি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয় এবং সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়।
পলিথিন অপচনশীল বলে দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে অবিকৃত অবস্থায় থেকে মাটিতে সূর্যালোক, পানি এবং অন্যান্য উপাদান প্রবেশে বাঁধা সৃষ্টি করে; পঁচে না বলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যায়, উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের বিস্তারে বাঁধা সৃষ্টি করে।

পলিথিনে মোড়ানো গরম খাবার গ্রহণ করলে ক্যান্সার ও চর্মরোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। পলিথিনে মাছ ও মাংস প্যাকিং করা হলে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হয়, যা মাছ ও মাংস দ্রুত পঁচনে সহায়তা করে; পিভিসি এবং অন্যান্য প্লাষ্টিক জাতীয় আবর্জনা ৭০০ সে. তাপমাত্রার নিচে পোড়ালে ডাইঅক্সিন জাতীয় বিষাক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয় যা জন্মগত ত্রুটি, চর্মরোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি মারাতœক রোগের জন্য দায়ী; উজ্জ্বল রঙের পলিথিনে রয়েছে সীসা ও ক্যাডমিয়াম যার সংম্পর্শে শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ও চর্র্মপ্রদাহের সৃষ্টি হয়; ওভেনপ্রুফ প্লাষ্টিক কনটেইনার খাবার গরম করলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে খাবারে ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক, সীসা মিশে যায় যার ফলে মরাত্মক রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে; পলিথিন থেকে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়া ত্বকের বিভিন্ন রোগের জন্ম দেয়, এমনকি ডায়রিয়া ও আমাশয় ছড়াতে পারে এ ব্যাকটেরিয়া থেকে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (২০০২ সনের ৯ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ৬ক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার সকল বা যে কোন প্রকার পলিথিন শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরী অন্য কোন সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে, এরূপ সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ৬ক ধারার বিধানাবলী লংঘন পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (২০১০ সনের ৫০ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ১৫ (১) ধারায় বর্ণিত টেবিলের ৪নং ক্রমিকে উল্লেখিত দন্ড আরোপণীয় হবে। ধারা ৬ক এর অধীন প্রদত্ত নির্দেশ লংঘনক্রমে বর্ণিত সামগ্রী (ক) উৎপাদন, আমদানী, বাজারজাতকরণ -এ প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে অনধিক দুই বছর কারাদন্ড বা অনধিক দুই লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড; পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যূন দুই বছর, অনধিক দশ বছর কারাদন্ড বা অন্যূন দুই লক্ষ টাকা, অনধিক দশ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ড এবং (খ)  বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার -এ অনধিক এক বছর কারাদন্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে।
DSC_9359
সরকার পরিবেশের গুরুত্ব বিবেচনায় ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাতকরণের উপর আইন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এ আইন দেশের জনগণ সানন্দে গ্রহণ করে। আইন প্রণীত হওয়ায় এবং তা বাস্তবায়নের ফলে পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে বর্তমানে আইনটি কার্যকর হচ্ছে না। পলিথিনের ব্যবহার সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কোন কার্যকর তৎপরতা এবং মনিটরিং না থাকায় নিষিদ্ধ পলিথিনে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। একই সঙ্গে রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের  অবহেলাও।
পলিথিন ব্যবহারের কারণে জনজীবন, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পাটের কদর কমে যাচ্ছে, কমছে পাট চাষ। বন্ধ হচ্ছে পাট দিয়ে উৎপাদিত পণ্যের কারখানা। বেকার হচ্ছে কুটিরশিল্পের মালিক ও শ্রমিক-কর্মচারীরা। সারা বিশ্বে পাটের চাহিদা বাড়লেও আমাদের অবহেলা ও সচেনতার অভাবে সোনালি আঁশ পাট আজ বিলুপ্তির পথে। আমাদের এ শিল্পকে ফিরিয়ে আনতে সরকারকে কার্যকর ভ’মিকা পালন করতে হবে এবং জনগণকে সচেতন হতে হবে।

পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৩ নং আইন) (২০১৩ সনের ৩৮ নং আইন দ্বারা সংশোধিত) এর ধারা-৪ পণ্য সামগ্রীতে পাটজাত মোড়ক ব্যবহারঃ কোন ব্যক্তি বিধি দ্বারা নির্ধারিত পণ্য, পাটজাত মোড়ক দ্বারা মোড়কজাতকরণ ব্যতিত, বিক্রয়, বিতরণ বা সরবরাহ করতে পারবে না। ধারা-১৪ পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যবহার না করার দন্ডঃ কোন ব্যক্তি বিধি দ্বারা নির্ধারিত পণ্যে পাটজাত মোড়ক ব্যহার না করে কৃত্রিম মোড়ক দ্বারা কোন পণ্য বা পণ্য সামগ্রী মোড়কজাতকরণ, বিক্রয়, বিতরণ বা সরবরাহ করলে তিনি অনূর্ধ্ব ১ বৎসর কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন। ধারা-১৫ অপরাধ পুনঃসংঘটনের দন্ডঃ কোন অপরাধের জন্য দন্ডিত ব্যক্তি যদি পুনরায় একই অপরাধ করেন তা হলে তিনি উক্ত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যে দন্ড রয়েছে তার দ্বিগুন দন্ডে দন্ডনীয় হবেন।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখের প্রজ্ঞাপনে ধান, চাল, গম ও ভুট্রা মোড়কীকরণে ১০০% পাটজাত বস্তা করতে হবে; দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত সারের ৫০% পাটের বস্তায় মোড়কীকরণ করতে হবে; দেশে উৎপাদিত চিনির ৫০% মানসম্পন্ন লেমিনেটেড হেসিয়ান ব্যাগ (বিএসটিআই এর মান অনুযায়ী) দ্বারা মোড়কীকরণ করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী বছরে প্রায় ৫০০(পাঁচ শত) বিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে, যা প্রতি মিনিটে  ১(এক) মিলিয়ন । ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সমুদ্র সৈকত, লেক এবং নদীতে বছরে ৮(আট) বিলিয়নেরও বেশী পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য ও শহরের গ্রোসারী মার্কেট এবং শপিং মলে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে সেখানে বর্তমানে প্রায় ১০০(এক শত) মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে, যা আগামী ৫ বছরে ৫০ গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এ চাহিদার শতকরা মাত্র তিন থেকে পাঁচ ভাগ রফতানি করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধুমাত্র আমেরিকায় পাটের ব্যাগ রফতানি করে বছরে ১ (এক) বিলিয়ন মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব।

পবার নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো: আবদুস সোবহানের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন গ্রীন মাইন্ড সোসাইটির সভাপতি আমির হাসান, মডার্ণ ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসনাত, পবার সমন্বয়কারী আতিক মোরশেদ, ইউপিএফের সভাপতি জহিরুল ইসলাম জনি, পরিবেশ সাংস্কৃতিক মঞ্চের পরিচালক মিজান শরীফ খোকা, বিসিএইচআরডির নির্বাহী পরিচালক মো: মাহবুল হক, জনউদ্যোগের সদস্যসচিব তারিক হোসেন মিঠুল, দেবীদাস ঘাট সমাজ কল্যাণ সংঘের সভাপতি মো: মুসা, মাস্তুল ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী রিয়াজ, এসডোর প্রজেক্ট এসোসিয়েটস বিদ্যুৎ চন্দ্র সরকার, উজ্জয়নী মহিলা সংগঠনের রাজিয়া সামাদ, অরুণোদয়ের তরুণ দলের হোসাইন প্রমুখ।

মানববন্ধন থেকে নিন্মোক্ত দাবীসমূহ করা হয়-
পলিথিন নিষিদ্ধ আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে, পাটের ব্যবহার বাড়বে, মাঠ পর্যায়ে কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাটের ব্যাগ আমেরিকায় রফতানির উদ্যোগ নেয়া হলে রফতানি আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষক পাট চাষে উৎসাহিত হবে এবং পাটের ন্যায্য দাম পাবে। বাংলাদেশ সোনালী আঁশ পাটের ঐতিহ্য ফিরে পাবে।

পলিথিন নিষিদ্ধকরণ আইন বাস্তবায়ন করা, পলিথিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার বন্ধ করা এবং পাটের ব্যাগ ব্যবহার করা।
বিদ্যমান আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা।
পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ ও ঠোংগা  ইত্যাদি সহজলভ্য করা এবং এগুলো ব্যবহারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা।
পলিথিন শপিং ব্যাগ তৈরীর কাঁচামালের উপর উচ্চ হারে করারোপ করা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics