এসডো- ইউএনইপি যৌথ প্রতিবেদনঃ দেশে ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে পারদ ব্যবহার
বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্যে ক্ষতিকর মার্কারী ব্যবহৃত হচ্ছে। যার মধ্যে রয়েছে ডেন্টাল অ্যামালগাম,বিভিন্ন প্রসাধনী সমগ্রী, থার্মোমিটার, বাচ্চাদের খেলনা ইত্যাদি। এমনকি খাদ্যপ্রক্রিয়াজাতকরণ কাজেও এর ব্যবহার দেখা গেছে।
সম্প্রতি এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এসডোর এক গবেষণায় এই তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৪ সালে প্রায় ৫৮.৫ মেট্রিক টন ক্ষতিকর পারদ আমদানী করা হয়েছে। তবে এর ব্যবহারের কোন নীতিমালা না থাকায় ক্ষতিকর পারদ যত্রতত্র ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে “রিডাকশন অব ডিমান্ড –ফর মার্কারী, ইন মার্কারী কনটেইনিং প্রোডাক্টস ইন বাংলাদেশ’’ শীর্ষক এক জাতীয় কর্মশালায় গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এসডো এবং জাতিসংঘের পরিবেশ প্রোগ্রাম (UNEP) যৌথ উদ্যোগে এই প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ এবং বন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় সচিব, ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, “ডেন্টাল অ্যামালগাম, প্রসাধনী সামগ্রী, থার্মোমিটার, বাচ্চাদের খেলনা এবং অন্যান্য পণ্য ও খাদ্যে মার্কারির ব্যবহার বন্ধে অতিদ্রুততার সাথে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন”। ২০১৭ সালের মধ্যে সারা দেশে পারদ ও পারদযুক্ত পণ্যের ব্যবহার বন্ধ করতে হলে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন “বাংলাদেশ যেহেতু মিনামাতা কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে, তাই অতি দ্রুত মিনামাতা কনভেনশন র্যাটিফাই তথা বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা ইতোমধ্যেই মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।আশা করছি, খুব শীঘ্রই কনভেনশনটি আমারা রেটিফাই করতে সক্ষম হব”। বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে মার্কারির ব্যবহার কমাতে এসডোর এই ধরনের উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান। ড. কামাল আরোও বলেন “এসডোর পরিচালিত এই গবেষণা রিপোর্ট একটি মূল্যবান সম্পদ, এটা যে শুধু সরকারকে মিনামাতা কনভেনশন রেটিফাই করতে সাহায্য করবে তা নয়, এই প্রতিবেদন, মার্কারি বিষয়ে সচেতনতা এবং সরকারের নীতিনির্ধারনের জন্য একটি মাইলফলক হবে “।
উক্ত অনুষ্ঠানে সভপতিত্ব করেন,গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ এবং বন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও এসডোর চেয়ারপারসন সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ। তিনি মার্কারীমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে সকলের প্রতি আহবান জানান।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ডঃ আবু জাফর মাহমুদ বলেন, ”মার্কারি একটি অত্যন্ত বিষাক্ত ধাতব পদার্থ, যা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের পরিবেশ ও মানবদেহে প্রবেশ করে। মার্কারি মস্তিষ্কের ক্ষতি করে, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টশক্তি হ্রাস করে, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। গর্ভবতী মা এবং শিশুদের উপরেও মার্কারির ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে’’ ।
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই),বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিল (বিসিএসআইআর),ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটি (বিডিএস) এর প্রতিনিধি সহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারা এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন এবং অবিলম্বে পারদ ও পারদযুক্ত পণ্য নিষিদ্ধের জন্য আহ্বান জানান।
ড. শাহরিয়ার হোসেন, UNEP র মার্কারী বিশেষজ্ঞ এবং এসডোর মহাসচিব তার বক্তব্যে বলেন, পারদ এখন বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির অন্যতম প্রধান কারন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ মিনামাতা কনভেনশনে স্বাক্ষর করে, মিনামাতা সনদ অনুযায়ী স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ২০২০ সালের মধ্যে সারা দেশে পারদের ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং থার্মোমিটার, বৈদ্যুতিক বাল্ব, পাওয়ার প্ল্যান্ট, এবং সিমেন্ট শিল্প থেকে পারদ নির্গমন হ্রাস করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এসডোর এই গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, মার্কারির এখন শুধুমাত্র শক্তি উৎপাদন বা স্বাস্থ্যখাতেই নয়, আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য পণ্যেও ব্যবহৃত হচ্ছে।বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী CFL বাল্ব, ডেন্টাল অ্যামালগাম, সিমেন্ট, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধন সামগ্রী, গহনা, সামুদ্রিক মাছ, রাসায়নিক সার,এমনকি খাদ্য চক্রেও এর উপস্থিতি রয়েছে যা নিঃসন্দেহে আমাদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে। এসডো এই ব্যাপারে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তিনি বাংলাদেশে মার্কারির ব্যবহার বন্ধে সরকারের কাছে আইন প্রণয়ন ও মিনামাতা কনভেনশন দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি জানান। তিনি বলেন সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে মিনামাটা কনভেনশন অনুযায়ী সকল পণ্যে মার্কারির ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, এসডোর নির্বাহী পরিচালক, সিদ্দিকা সুলতানা। তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর, বিএসটিআই, এবং বিসিএসআইআর, শিক্ষাবিদ সহ সবাইকে ধন্যবাদ জানান। সিদ্দিকা সুলতানা বলেন, মার্কারি একটি অত্যন্ত বিষাক্ত ধাতু। বিভিন্ন রকম ফ্যাক্টরি অথবা শিল্প কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া, চিকিৎসায় ব্যাবহৃত যন্ত্রপাতি ও ডেন্টাল অ্যামালগাম, ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত পারদ পরিবেশে মিশছে। যা বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের দেহে প্রবেশ করে। তিনি আরোও বলেন পারদ/মার্কারী দূষণ দূর করার একমাত্র উপায় বাংলাদেশে পারদ এবং পারদযুক্ত পণ্যের আমদানি, উৎপাদন ও বিক্রয় বন্ধ করার জন্য আইন প্রনয়ন করা এবং আইন কার্যকর করা।
উল্লেখ্য যে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে মোট ৫৮৫০০ কেজি বা ৫৮.৫ মেট্রিক টন পারদ আমদানি করা হয়। পারদ মূলত বিভিন্ন শিল্প খাতে (ক্লোরো – অ্যালকালি প্লান্ট, কাগজ ও কাগজের মণ্ড, সিমেন্ট উৎপাদন), স্বাস্থ্য খাতে (স্বাস্থ্য যন্ত্র, ডেন্টাল মিশ্রণ), জ্বালানি খাতে এবং ইলেকট্রনিক সেক্টরে (ইলেকট্রনিক ডিভাইস, ব্যাটারী, সিএফএল বাল্ব), প্রসাধনী খাত, গয়না সেক্টর এবং অন্যান্য খাতে ব্যবহৃত হয়। এসডোর জরিপ থেকে দেখা গেছে সারা দেশে ৮৮৭৪৭২ থার্মোমিটার ব্যবহার করা হয় এর ৩৭.৮% (৫৫২০০৭.৫৮) ব্যবহারের ফলে ভেঙ্গে যায়। একইভাবে সারা দেশে ৩০৫৯২৬ সিগ্মমোম্যানোমিটার ব্যবহৃত হয় এর ১০% (২৭৫৩৩৩.৪) ব্যবহারের ফলে ভেঙ্গে যায়।একটি স্ট্যান্ডার্ড থার্মোমিটারে ০.৫- ২.০ গ্রাম পারদ এবং একটি স্ট্যান্ডার্ড সিগ্মমোম্যানোমিটারে ৮০-১৬০ গ্রাম পারদ রয়েছে। এটা ধারণা করা হয় যে থার্মোমিটার ভাঙ্গার কারনে প্রতি বছর ০.৬৯ টন পারদ এবং সিগ্মমোম্যানোমিটারে ভাঙ্গার কারনে ৩.৩ টন পারদ পরিবেশ এবং বায়ুমন্ডলে মুক্ত হয়। এসডোর জরিপ থেকে দেখা গেছে, ডেন্টাল আমালগাম থেকে ৩ এবং ১৭ মাইক্রোগ্রাম পারদ বাষ্প মানবদেহে প্রবেশ করে, এবং এক বছরের মধ্যে প্রায় ৬২০৫ মিলিগ্রাম ১০৯৫ মিলিগ্রাম পারদ বাষ্প মানবদেহে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে ডেন্টাল খাত থেকে প্রতি বছর ডেন্টাল আমালগাম থেকে ১.০৯ থেকে ৬.২২ মেট্রিক টন পারদ বাষ্প তৈরি হয়।
বর্তমানে সারা বিশ্বে পারদ দূষণ ও তার প্রতিরোধে নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও প্রচারণা চলছে। এসডো তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পরিবেশ দূষণ রোধ ও সামাজিক কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। দূষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এসডো সর্বদা পথিকৃৎ হিসাবে অবদান রেখে আসছে।