ক্লাইমেট রিয়ালিটি লিডারশিপ কোরপ্সঃ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নতুন দিনের সেনানী
তানজিম-উল-ইসলাম
বৈশ্বিক উষ্ণতা বর্তমান সময়ে পরিবেশ রক্ষার সবচেয়ে বড় ইস্যু। প্রতিটি রাষ্ট্রই কোনো না কোনোভাবে এর সাথে জড়িত। তাই প্রত্যেক দেশে এমন মানুষের প্রয়োজন যারা ভয়াবহতার বার্তাকে ছড়িয়ে দিতে পারবেন। গত ২২-২৪ ফেব্রুয়ারী ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ক্লাইমেট রিয়ালিটি আয়োজিত ২৭ তম “ ক্লাইমেট রিয়ালিটি লিডারশিপ কোরপ্স ”। ক্লাইমেট রিয়ালিটি আমেরিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং নোবেল বিজয়ী আল গোরের প্রতিষ্ঠিত সংস্থা। সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কাজ করে যাচ্ছে। তারা এই ট্রেনিঙয়ের আয়োজন মূলত করে থাকে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আগ্রহীদেরকে তাদের এলাকায় কাজ করার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে। ট্রেনিং পাওয়ার পর একজন অংশগ্রহণকারীকে ক্লাইমেট লিডার নামে অভিহিত করা হয়। তাকে পরবর্তী এক বছরের মধ্যে দশটি “অ্যাক্টস অফ লিডারশিপ” সম্পন্ন করতে হয়। “অ্যাক্টস অফ লিডারশিপ” বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমনঃ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সরকারের প্রতিনিধির সাথে দেখার করা, জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর বক্তৃতা দেওয়া, সংবাদপত্রের সম্পাদকের কাছে চিঠি লেখা, ব্লগপোষ্ট লেখা ইত্যাদি।
এবারের ট্রেনিং মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা, এই সমস্যা সমাধানে নবায়নযোগ্য শক্তির অপার সম্ভাবনা এবং সমগ্র বিষয়ে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের ওপর জোর দেয়। এই ট্রেনিংয়ের মূল আকর্ষণ ছিল আল গোরের প্রেজেন্টেশন। তিনি দেড়দিন ধরে খুব যত্ন করে তার প্রেজেন্টেশন দেন। আল গোরের জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা সমাধানে জ্ঞান, দৃঢ়তা এবং আবেগের যে পরিচয় তার প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে পেয়েছি, তা অতুলনীয়! তার প্রেজেন্টেশনের ব্যাপারে প্রশ্ন করার সুযোগ ও ছিল। সেক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করার জন্য আরও তিনজন বিজ্ঞানী ছিলেন। তার এই প্রেজেন্টেশন এখন ক্লাইমেট লিডাররা তাদের এলাকায় ছড়িয়ে দিতে পারবেন! ক্লাইমেট লিডারদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “Change can happen if we all live like we’d like the change।‘ আমারও আল গোরের প্রেজেন্টেশন এখন তুলে ধরার অধিকার আছে!
অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন বেয়ারফুট কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সঞ্জিত বাংকার রায়। তার কলেজের সকল শিক্ষার্থী নিরক্ষর, এখানে কোন সার্টিফিকেট দেয়া হয় না। তারা কর্মমুখী শিক্ষা অর্জন করে স্বাবলম্বী হয়। এই কলেজের শিক্ষার্থীরা সোলার প্যানেল বানানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে বেয়ারফুট কলেজ আন্তর্জাতিক রূপ ধারণ করে আফ্রিকা অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে।
এছাড়াও ক্লাইমেট রিয়ালিটির সিইও কেন বার্লিন, ক্লাইমেট রিয়ালিটি লিডারশিপ কোরপ্স ডিরেক্টর মারিও ই মলিনা, ক্লাইমেট রিয়ালিটির বোর্ড মেম্বার ডন হেনরি, অস্ট্রেলিয়ান কনভারসেশন ফাউন্ডেশনের এঞ্জেলা রাটার প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য রাখেন।
বাংলাদেশ থেকে এবারের ট্রেনিংয়ে মোট আঠারোজন অংশ নেন। বাংলাদেশ থেকে মেন্টর হিসেবে নির্বাচিত হন জহরুল হক। অংশগ্রহণকারীদের মাঝে বিভিন্ন কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীরাও ছিলেন। বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারীরা এই ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়া বিভিন্ন দেশের বহু মানুষের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। বন্ধুত্ব গড়ে উঠে ভারত, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, ব্রাজিলসহ অন্যান্য দেশের জলবায়ু পরিবর্তন রোধের কান্ডারীদের সঙ্গে। এই ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়া বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মাঝে একটি মিল রয়েছে। তারা সবাই জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যার সমাধান করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে চায়! এজন্যই সবার মাঝে এত দ্রুত এত ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে!
ভারতে এই ট্রেনিং অনুষ্ঠিত হওয়ায় ভারত থেকে সর্বাধিক মানুষ অংশ নেয়। ভারতীয়দের সাথে আলোচনার সুযোগ হওয়ার সুবাদে আমি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নদীর পানিতে বাঁধ দেওয়া নিয়ে আলোচনা হয়। তারা সবাই আমাকে বলে যে তারাও নদীতে বাঁধের বিরোধী। এমনকি কানপুর আইআইটির প্রসেঞ্জিৎ এর সাথে কথা বলে জানা যায়, ভারতে বিভিন্ন নদীতে নয়টি নতুন বাঁধ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার শিক্ষক এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে চার বছরের জন্য তা স্থগিত করিয়েছেন। এছাড়াও “কনভারসেশন অ্যাকশন ট্রাস্ট” নামে ভারতীয় এক সংস্থা বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারীদের সাথে সুন্দরবনের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে একত্রে কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করে। উভয় দেশের সাধারণ মানুষ পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হলেও এক্ষেত্রে উভয় দেশের সরকারের সদিচ্ছা প্রয়োজন।
এই ট্রেনিংয়ে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা অসাধারণ ছিল! যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী, তারা ভবিষ্যৎ ট্রেনিংগুলোতে অংশ নেওয়ার জন্য এখন থেকেই আবেদন করতে পারেন। এই বছরের পরবর্তী তিনটি ট্রেনিংয়ের স্থান এবং সময়ঃ যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়ায় ৫-৭ মে, কানাডার টরন্টোতে ৯-১০ জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ২৮-৩০ সেপ্টেম্বর। যোগাযোগ করতে পারেন এই ওয়েবসাইটে www.ClimateRealityTraining.org
ধরনী তো আমাদেরই, একে তো আমরাই রক্ষা করব। তাই এই সম্মেলনে আল গোরের সাথে সুর মিলিয়ে এই অংগীকার করা- . “As the quote goes, ‘After the last no, comes a yes. On that yes, the future of the world depends’. We need to get to the ‘yes’ on solving the climate crisis.”
লেখকঃ ক্লাইমেট লিডার, ক্লাইমেট রিয়ালিটি লিডারশিপ কোরপ্স