হাঁসের শক্তিতে চলবে শহর!

ফারজানা হালিম নির্জন

চলুন,ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনথেকে একটু ঘুরে আসি। চমৎকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এই শহরটিতে হয়তো স্ব-শরীরে ঘুরে আসার সৌভাগ্য হয়েছে অনেকেরই। তবে আজ আমরা যাবো একটু ভবিষ্যতের কোপেনহেগেনে! যাত্রা-প্রস্তুতি হিসেবে শুধু লাগবে একটি কল্পনাবিলাসী মন। ভবিষ্যতের কথা বলছি- কারণ, বর্তমানে আপনি ওখানে গেলে সেই বিস্ময়কর জিনিসটি দেখতে পাবেন না। তার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে। এই ফাঁকে কল্পনায় দেখে ফেললে সমস্যা কোথায়?

পৃথিবীর ইতিহাসে সুবিশাল আকৃতির হাঁসের অস্তিত্ব না মিললেও, অচিরেই তা মিলতে যাচ্ছে কোপেনহেগেনে! আপনার ভালর জন্যই আগে-ভাগে বলে রাখছি, সেখানে যদি বেড়াতে যান,তবে এই হাঁস কিন্তু আপনাকে দেখতেই হবে। হাঁসের আকৃতি দেখে আবার ভয় পাবেন না যেন! মজার ব্যাপার হচ্ছে,এটি রুপকথার গল্প থেকে উঠে আসা কোনো ছদ্মবেশী দৈত্য-দানব না। মানুষের শুভাকাংখী হয়েই সে আসতে যাচ্ছে আর কিছুদিনের মাঝেই। এই হাঁসের নাম হলো “এনার্জি ডাক”!EnergyDuck-LAGI

 চলতি বছর,২০১৪ তে “ল্যান্ড আর্ট জেনারেটর ইনিশিয়েটিভ” প্রতিযোগীতায় একদল ব্রিটিশ নকশাকার এই অতিকায় বৃহৎ আকৃতির এনার্জি ডাক- প্রকল্পটি উপস্থাপন করেন। এর ক্রিয়া-কৌশল, আকর্ষণীয় বাহ্যিক আকৃতি ও অন্যান্য সুবিধাসমূহ দেখে আশা করাই যায়অচিরেই এর বাস্তবায়িত রূপ কোপেনহাগেন অধিবাসী দেখতে যাচ্ছে। সৌরশক্তি সঞ্চয় ও সরবরাহ এবং একই সাথে পানির প্লবতা ধর্ম কাজে লাগিয়ে শক্তির বিশাল ভান্ডার রূপে পানিতে হেসে-খেলে বেড়ানোই এই এনার্জি ডাক-এর প্রধান কাজ! চলুন জেনে ফেলি,তার কাজের পেছনের কৌশল!

এনার্জি ডাক-এর বাইরের আবরণ শত শত চকমকে ফটোভলটাইক প্যানেল দিয়ে তৈরী,যাদের কাজ সৌরশক্তি কে খুব সহজেই সংরক্ষণ করে রাখা। আবার একই সাথেপানি থেকে যে পরিমাণ শক্তি বিকিরিত হয়,সেটিকেও সংরক্ষণ করে রাখা! আর ভেতরে আছে হাইড্রো টারবাইন। আকর্ষনীয় ব্যাপার হচ্ছে, কাজের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে এটি কিছু সময় পানিতে হালকা নিমজ্জিত অবস্থায় থাকবে। আবার কিছু সময় পানিতে ভেসে বেড়াবে ঠিক সত্যিকারের হাঁসের মতই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে,কেমন করে এই কৃত্রিম হাঁস কাজ করবে? কেমন করে শক্তি সংরক্ষণ ও তৈরী করবে? আর কিভাবেইবা পেটের ভিতরের সঞ্চিত শক্তিকে পৌঁছে দেবে সকল গ্রীডে? EnergyDuck-LAG 4

তিনটি ধাপে খুব সহজেই বুঝে ফেলা যায় এর কাজের ধারা। হাঁস এবার ধরা পড়ে গেলো!

১। সূর্যের রশ্মি থেকে যতটা সম্ভব শক্তি সংরক্ষণ করছে ফটোভলটাইক প্যানেল। আর সাথে সাথে সেই শক্তিকে রুপান্তর করে বিদ্যুতে পরিণত করছে। বিদ্যুতের আশীর্বাদস্বরূপ শহরবাসীকে সেবা দিচ্ছে আয়েসী ভঙ্গিমায়। সব বিদ্যুত নগরবাসীকে দিয়ে দিলেও সৌরশক্তির কল্যাণে বেশ খানিকটা শক্তি কিন্তু চুপি চুপি নিজের পেটেও পুরে দিচ্ছে! অবশ্য, নিজের জন্য রেখে সে করবেই বা কি! এই হাঁস বেশ চালাক প্রকৃতির। যখন সূর্য থাকবেনা,তখন যেন সংরক্ষিত শক্তিকে আবার নগরবাসীর কল্যাণে ব্যাবহার করতে পারে,সেই পরিকল্পনা মাথায় রেখেই সর্বোচ্চ যতটুকু সম্ভব শক্তি জমিয়েও রাখছে ! ছোটবেলার কবিতাটা মনে আছে না? “শীতের সঞ্চয় চাই/খাদ্য খুঁজিতেছি তাই,ছয় পায়ে পিলপিল চলি…” হুম, পীপিলীকার মত এই চালাক হাঁস কিন্তু সে অর্থে বেশ পরিশ্রমীও বটে! আর হ্যাঁ, এই পুরো প্রক্রিয়াটি চলাকালীন অবস্থায় সে বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে পানিতে ভেসে বেড়ায়।

২। ওদিকে পেটের ভিতর কি হচ্ছে শুনুন। সূর্য গেলো ডুবে। আর তখনই হাঁসটি একটু একটু করে পানিতে ডুবতে থাকলো। এনার্জি স্টোর যেহেতু পানিতে ডুবতে থাকলো,তখনই হাইড্রো টারবাইন শুরু করে দিলো তার কাজ! সংরক্ষিত শক্তিকে এবার কাজে লাগানোর পালা। ফটোভলটাইক প্যানেলের এবার বিশ্রামের সময়। তাই বিদ্যুৎশক্তিকে গ্রীডে পৌঁছানোর দায়িত্ব বেশ গুরু-গম্ভীরভাবে অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে হাইড্রো টারবাইন। ওদিকে সংরক্ষিত শক্তিকেও ছড়িয়ে দিচ্ছে শহরবাসীর জন্য। রাতের আঁধারে,কিংবা মেঘলা দিনে। এমনি করেই অর্ধ নিমজ্জিত অবস্থায় এই এনার্জি ডাক তার কাজ করে যাবে ঠিক নিপুণ কারিগরের মতোই!

 ৩। ভোরের আলো ফুঁটছে। সারারাতের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর হাইড্রো টারবাইনের এবার বিশ্রাম নেবার একটু সময় এলো। নতুন উদ্যমে কাজ করার প্রস্তুতি নিলো ফটোভলটাইক প্যানেল। ঘুম ঘুম চোখে প্রায় নিমজ্জিত হাঁস এবার একটু একটু করে ভাসতে শুরু করলো। ফটোভলটাইক প্যানেলের তৎপরতায় ভেতরের পাম্প গেলো চালু হয়ে! তার কাজ হচ্ছেপেটের ভেতরের পানিটাকে অনেকটা সেচ প্রক্রিয়ায় বাইরে ফেলে দেয়া। জমাকৃত এনার্জীর পুরোটাই তো প্রায় ব্যাবহার হয়ে গেছে। তাই আবার নতুন করে কাজ শুরু করবার জন্য প্রস্তুত ফটোভলটাইক প্যানেল। সৌরশক্তি থেকে আবারো সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন আর নগরবাসীর জন্য তা সরবরাহ করা। পাম্পের সাহায্যে পানি বের হচ্ছে আর হাঁস একটু একটু করে ভেসে উঠছে। তার মাথায় তখন একটাই চিন্তা, কী জানেন? “সৌরশক্তিটাকে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করার কাজ শুরু করবো কখন?”EnergyDuck-LAGI2

ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় এক ধরণের সত্যিকারের হাঁস দেখতে পাওয়া যায়। এরা আকারে খানিকটা বড় হয়। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন তাদের জীবন-প্রক্রিয়ার উপর বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। শিল্পী হ্যারেথ পোচি,আদম খান,লুইস লেগার ও প্যাট্রিক ফ্রায়ার এই অসহায় হাঁস প্রজাতির চিন্তা মাথায় রেখেই চমৎকার এই এনার্জি ডাক উপহার দিতে চাচ্ছেন কোপেনহেগেনের মাধ্যমে সারা বিশ্বকেই! দিনের সুরভিত আলোয়,রাতের আঁধারে নিজের শরীর থেকে চমৎকার আলো ছড়িয়ে যে হাঁস কিনা বিশুদ্ধ এনার্জি সরবরাহ করতে চায় একমাত্র মানব-প্রজাতির কল্যাণে,তার তো এই পৃথিবীতে আসা খুব জরুরি,তাইনা? কল্পণার রাজ্য থেকে এবার একটু নেমে আসুন বাস্তবতায়। খুব বেশিদিন হয়তো অপেক্ষা করতে হবেনা। এই শিক্ষিত,চালাক-চতুর, বিনোদনের খোরাক, শুভাকাংখী এনার্জি ডাক হয়তো খুব শীঘ্রই সর্বসম্মতিক্রমে কোপেনহেগেনে আস্তানা গাঁড়তে যাচ্ছে! তখন নাহয় সত্যিই একদিন সময় করে দেখে এলেন সেই চমৎকার হাঁসটিকে!

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Discover more from EnvironmentMove.earth

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

Verified by ExactMetrics